অনীক দত্ত
ভূতেদের যে আদৌ নোটের প্রয়োজন আছে, সেই প্রস্তাবটাই অদ্ভূত লাগতে পারে। ক্ষেত্র বিশেষে ভুতুড়ে শব্দটার মানে পাল্টে পাল্টে যায়। আসলে ভূত শুধু মরণোত্তর দশাই নয়, বাতিল হয়ে যাওয়া মানুষও এক প্রকার ভূত। এক জন পুরনো আমলের টাইপিস্ট, যিনি কম্পিউটারে বাংলা হরফ টাইপ করতে পারেন না, তিনিও কার্যত ভূত। আবার এক জন ওল্ড স্কুল মার্ক্সিস্ট বা ‘শিক্ষিত বাঙালি ভদ্দরলোকও’ এখন প্রায় ভূত হওয়ার পথেই। আগেকার সেই বক্সওয়ালারাও নব্য কর্পোরেটদের দাপটে এক ধরনের ভূত হয়ে গিয়েছে। বাস্তবে এরা হলেন এমন কিছু লোকজন, যাঁরা আশপাশের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে না পেরে নিজেদের গর্তে ঢুকে প়ড়েছেন, ‘সার্ভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’-এর দৌড়ে এঁরা আসলে সার্ভাইভ করতে পারেননি। ফলে ‘ফিটেস্ট’-এর সংজ্ঞাটাও হয়ে গিয়েছে অন্য রকম। আমিও হয়তো এদের দলেই।
তেমনই পাঁচশো আর এক হাজার টাকার নোটের ভূত। আপাতত এই নোট, মানে ভূতগুলোই, বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন জনের ঘাড়ে চাপছে। এই ভূত যার কাছে যত বেশি আছে, তাদের চাপ তত বেশি।
পরিবর্তনকে স্বাগত। বিশেষ করে যদি তা কোনও বৃহৎ ভাল বা ইতিবাচক উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে। কিন্তু যে কোনও ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আমাদের মধ্যে একটা সন্দেহপ্রবণতা রয়েছে। বিশেষ করে কিছু দিন আগে যে রাজনৈতিক দলকে তেহলকায় প্রচুর নোট নিতে দেখা গিয়েছে, তারা যখন কালোকে এক রাতে সাদা করার কথা বলে, তখন অবশ্যই সংশয় কাজ করে।
আপাতত যদি ধরেও নিই যে নরেন্দ্র মোদীর গৃহীত সিদ্ধান্ত বৃহত্তর ভালর জন্য, তা হলেও একটা সংশয় রয়েই যায়, এর পিছনে আর কোনও উদ্দেশ্য নেই তো?
গরিবদের বড়লোকদের প্রতি একটা স্বভাবগত রাগ থাকেই। তাই তথাকথিত গরিবদের স্বার্থে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত অবশ্যই ভোট টানবে। যেমন অনেক সময় দেখা যায়, গ্রামে-গঞ্জে পরীক্ষায় টুকতে দিলে ভাল ভোট পাওয়া যায়। এই নোটের ভূতের আসল উদ্দেশ্যেও তেমনই ঘুষের মাধ্যমে ভোট টানা নয়তো? যেমন একটা সময় অনেক প্রতিশ্রুতি নিয়ে অরবিন্দ কেজরীবাল হাজির হয়েছিলেন। আমার মধ্যেও একটা আশা তৈরি হয়েছিল, হয়তো এ বার অনেক পরিবর্তন হবে। কিন্তু পরে বেশ কিছু ক্ষেত্রে মোহভঙ্গ হয়েছে।
যদি ধরে নিই, অসৎ উদ্দেশ্য নিয়েও কোনও সৎ কার্য সাধিত হয়, তাতে ক্ষতি কী? ভিতরে ভিতরে সকলেই চায় সমাজ অর্থনীতি দুর্নীতি মুক্ত হোক। যদিও শাশ্বত সততা, শাশ্বত দুর্নীতি বা সততার প্রতীক বলে কিছু হয় না। তবুও মানুষ খড়কুটো আঁকড়ে বাঁচতে ভালবাসে। তাই আমরা সকলেই চাই, কিছুটা অন্তত হোক। তবে যতটা ‘গেল গেল’ রব উঠছে ততটা হয়তো ঠিক নয়। আবার বিজেপির এই যে প্রচার— সব একেবারে পরিষ্কার হয়ে গেল— সেই ভণ্ডামিটাও বোধহয় ঠিক নয়।
আর একটা বড় বাস্তব সমস্যা হল— প্রয়োগ। আমাদের দেশে ভাল ভাল আইন প্রণয়ন হলেও তার বাস্তব প্রয়োগ কতটা হয়, তা নিয়ে সংশয় আছে। এ বারের পরিবর্তনের সঙ্গেও বেশ কিছু ইতিবাচক এবং নেতিবাচক বদল এসেছে। যেমন অসুস্থতার কারণে আমার সিগারেট খাওয়া নিষেধ। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ে তা মানতে পারি না। এখন খুচরোর আকালে দরকারি জিনিসের বাইরে সেই নেশার শখটুকুতে আপস করতে হচ্ছে। দিনকতক আগেই আমার নতুন ছবির জন্য কস্টিউম কিনতে বেরিয়েছিলাম। কিছু চরিত্রের জন্য একেবারে ফুটপাথ থেকে সাধারণ জামাকাপড় কেনার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু হাতে ১০০০ আর ৫০০-র নোট। তাই কস্টিউম পছন্দ করে দোকানদারকে বলি, ‘‘আপনি এগুলো রেখে দিন। আমরা পরে নিয়ে যাব।’’ তিনি হঠাৎ বলেন, ‘‘থাক দাদা ওই নোটই দিন। পরে না হয় ব্যাঙ্কে গিয়ে ভাঙিয়ে নেব। সন্ধে ৬টা বেজে গিয়েছে। এখনও পর্যন্ত আপনিই তো প্রথম কাস্টমার।’’ নতুন ছবি শুরু হওয়ার আগে এমন নানা অসুবিধা হচ্ছে। প্রায় প্রত্যেককেই এমন কোনও না কোনও অসুবিধায় ভুগতে হচ্ছে। এত কিছু সত্ত্বেও যদি ফাইনাল এফেক্টটা ভাল হয়, প্রয়োগের সমস্যাটা মেটে, অন্ধকার শেষে আলোর রেখা দেখতে পাই আর ভবিষ্যতে কোনও নোট ভূত না হয়— তা হলে আমি এখন ভুগতে রাজি আছি।
তবে বেশ কয়েক দিন ধরে চলা এই ডামাডোল দেখে কয়েকটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে— পরিকল্পনার এত অভাব কেন? সমস্যা কবে মিটবে, কী ভাবে মিটবে তা খোলসা করে মানুষকে জানাতে অসুবিধা কোথায়? বিরোধীরা বিরোধিতার কথা বলছেন। বহু অর্থনীতিবিদেরও এ নিয়ে নানা মত— সে নিয়ে আর বিশদ বিতর্কে যাচ্ছি না।
আরও একটা মজাদার দিক ইদানীং চোখে পড়ছে। যে কোনও ক্রান্তিকালকে পেরোতে হলেই কিছু দিন ধরে দেখছি বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে কার্টুন আর জোকসের ঝড় চলছে। তার মধ্যে সবই যে দুর্দান্ত, তা নয়। তবু খানিকটা মাথা খাটানো তো চলছে, তা অস্বীকার করি কী করে।
আমরা মানুষেরা যে কোনও পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে জানি। সঙ্কটের সময়ে ব্যবসার সুযোগও বাড়ে। তাই এখন গ্রামগঞ্জ থেকে গরিব লোকজন এনে টাকা খুচরো করার লাইনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বদলে তাঁরাও বড়লোকদের টাকার খুব সামান্য অংশ হলেও সরাসরি হাতে পাচ্ছেন। এর ফলে কিছুটা হলেও টাকা বড়লোকদের থেকে গরিবের পকেটে চালান হচ্ছে। এই কালো টাকা যদি বড়লোক ব্যক্তিটি ট্যাক্স হিসেবে দিতেন, হয়তো সেই টাকায় কিছু মন্ত্রী আমলা বিদেশভ্রমণ সেরে আসতেন। আমার মন বলছে, নির্বাচনের সময়ে লাইনে ভুতুড়ে ভোটারদের মতো টাকা জমা দেওয়ার লাইনেও ভূত ক্রমশ বাড়বে। বাড়বে ভুতুড়ে ডিপোসিটরও। এরাই হয়তো হয়ে উঠবে ভবিষ্যতের ভূত!