সবিতা বিশ্বাস, রেখা মুনি এবং রিতা চক্রবর্তী। —নিজস্ব চিত্র।
পথটা কঠিন, প্রতিকূলও।
চলতে গেলেই উড়ে আসে উপহাস, করুণা, ব্যঙ্গ!
তবু হাল ছাড়েননি ওঁরা। মানে— রিতা, সবিতা, রেখারা।
বিয়ের আগে-পরে শ্বশুরবাড়ির দাবিমতো পণ মেটাতে না-পারলে গঞ্জনা-অত্যাচারের জেরে অনেক মহিলাই আত্মহননের পথ বেঁচে নেন। কারও শ্বশুরবাড়ির বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ ওঠে। তবে অনেক মহিলা সাহস করে বিবাহ-বিচ্ছেদ চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন। অশোকনগরের রিতা চক্রবর্তী, শ্যামনগরের সবিতা বিশ্বাস বা পার্কসার্কাসের রেখা মুনি খুঁজে নিয়েছেন স্বনির্ভর হওয়ার রাস্তা। পরোয়া করেননি বাপের বাড়ির আশ্রয়েরও।
কতটা কঠিন সেই পথ?
বারো বছর আগে রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে সতেরো বছরের বড় পাত্রের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল অশোকনগরের রিতার। তাঁর বয়স তখন ২০। দেড় বছরের ব্যবধানে দু’টি সন্তানের জন্ম দিলেন। তারপরই টাকা আনার দাবিতে শ্বশুরবাড়িতে মারধর শুরু হয় বলে অভিযোগ। ২০১০ সালে সন্তানদের নিয়ে বাপের বাড়ি ফেরেন রিতা। নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেন। কিন্তু স্বস্তি পাননি। অভিযোগ, বাপের বাড়িতে থাকার জন্য পড়শি এবং কাছের লোকেদের ‘বাঁকা কথা’ কানে বিঁধতে থাকে। দু’বছর পরে শ্বশুরবাড়ি ফেরেন রিতা। ফের সেখানে মারধর শুরু হয় বলে অভিযোগ। দু’বছর আগে রিতা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দ্বারস্থ হন। এক বন্ধুর সাহায্যে গত বছর একটি বহুজাতিক সংস্থায় চাকরি পান তিনি।
রিতা এখন বেহালায় একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকেন। ‘পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ নিয়ে পড়াশোনাও চালাচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘টাকা আনতে না-পারার জন্য স্বামী রাতে মত্ত অবস্থায় মারতে মারতে রাস্তায় বের করে দিত। অনেক সহ্য করেছি। মানসম্মান বিসর্জন না-দিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম। এখন ভাল আছি।’’
গায়ে পোড়া দাগ নিয়ে ‘ভাল আছেন’ সবিতাও। সাত বছর আগে মারধরের পরে শ্বশুরবাড়ির লোকজন বারাসতের ওই মহিলার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন বলে অভিযোগ। শ্যামনগরে বাপের বাড়িতে এসে ওঠেন সবিতা। কিন্তু তাঁকেও ‘বক্রোক্তি’ শুনতে হয় বলে অভিযোগ। বাপের বাড়িও ছাড়েন সবিতা। নানা জায়গায় ঘুরে আপাতত তিনি ঢাকুরিয়ার একটি হোমে আশ্রয় পান। জুটিয়ে নিয়েছেন একটি সাংস্কৃতিক সংস্থার চাকরি। তাঁর জেদ, ‘‘যে লড়াই শুরু করেছি, তার শেষ দেখে ছাড়ব না।’’
একই রকম জেদ নিয়ে পাঁচ বছর ধরে লড়াই চালাচ্ছেন পার্ক সার্কাসের রেখা মুনি দেবীও। বিহারের ওই তরুণীর ২০০৫ সালে বিয়ে হয়েছিল। তার পরে একই করুণ-কাহিনি। ছ’মাস বাপের বাড়িতে কাটিয়ে ফিরে আসেন কলকাতায়। একা থাকেন। সেলাইয়ের কাজ করে তাঁর দিন চলে। ঠিকমতো খাবার জোটে না। তবুও রেখা বলেন, ‘‘আমার অধিকার রক্ষার লড়াই লড়ছি। সকলে পাশে দাঁড়াবেন এটুকুই চাই।’’
কিন্তু সকলকে তাঁরা পাশে পেলেন কই? নিজের লোকেদের থেকেও বাঁকা কথা শুনতে হয়েছে বলে তাঁরাই তো অভিযোগ করছেন!
সমস্যাটা সহজে মেটার নয় বলেই মনে করেন সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অনন্যা চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘পুরুষতান্ত্রিক সমাজ এবং মানসিকতা মেয়েদের উপরে পণের জন্য অত্যাচার করে। ওই সব মেয়েরা স্বাধীন ভাবে বাঁচুক, এটাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ স্বীকার করতে চায় না। তাই উপহাস, করুণা বা ব্যঙ্গ জোটে। মেয়েমানুষ নয়, মানুষ হিসেবে যতদিন না মহিলাদের গ্রহণ করা হচ্ছে, এই সমস্যা থাকবে।’’ সমস্যা মেটাতে না-পারলেও রিতা-সবিতার মতো মহিলাদের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন মানবাধিকার কর্মী কবিতা গুপ্ত। তিনি বলেন, ‘‘অসহায় ওই সব মহিলাদের যাতে মাথার উপরে ছাদের অভাব না-হয়, সে ব্যাপারে ভাবনাচিন্তা করছি।’’