নিশানায় ফের বাম, শহরে তাণ্ডব কাউন্সিলরের বাড়িতে

তৃণমূলের সার্বিক সাফল্যের মধ্যেই পুরভোটে দ্বিতীয় স্থান ধরে রেখেছে বামেরা। শিলিগুড়িতে চমকপ্রদ সাফল্যের পাশাপাশি অন্যত্র শাসক দলের সন্ত্রাসের ভূরি ভূরি অভিযোগের মধ্যেও বামেদের ভোট সামান্য বেড়েছে। আগামী বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের সঙ্গে বামেদের ভোটের ফারাক কমে আসার ইঙ্গিত ধরা পড়তে শুরু করেছে নানা সমীক্ষায়। আর এ সবের জেরে হামলা বাড়ছে সিপিএমের উপরে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৫ ০৪:৩০
Share:

মাঝরাতে বাড়িতে হামলা। আতঙ্কিত সিপিএম কাউন্সিলর অন্নপূর্ণা দাস। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।

তৃণমূলের সার্বিক সাফল্যের মধ্যেই পুরভোটে দ্বিতীয় স্থান ধরে রেখেছে বামেরা। শিলিগুড়িতে চমকপ্রদ সাফল্যের পাশাপাশি অন্যত্র শাসক দলের সন্ত্রাসের ভূরি ভূরি অভিযোগের মধ্যেও বামেদের ভোট সামান্য বেড়েছে। আগামী বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের সঙ্গে বামেদের ভোটের ফারাক কমে আসার ইঙ্গিত ধরা পড়তে শুরু করেছে নানা সমীক্ষায়। আর এ সবের জেরে হামলা বাড়ছে সিপিএমের উপরে। খাস কলকাতার কসবায় মধ্যরাতে বাড়িতে দুষ্কৃতীদের হামলায় আতঙ্কিত হয়ে সিপিএমের বছর ষাটেকের মহিলা কাউন্সিলরকে যে ভাবে শৌচাগারে লুকোতে হয়েছে, তার জেরে এমন অভিযোগই করছেন বাম নেতারা।

Advertisement

বস্তুত, পুরভোটে বিজেপি-র রথের গতি থমকে যেতেই স্বয়ং তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফের তাঁর পুরনো কায়দায় আক্রমণের নিশানায় ফিরিয়ে এনেছেন সিপিএমকে। বিজেপির উত্থান রুখতে মরিয়া যে মমতা এক সময় প্রয়োজনে আলিমুদ্দিনে গিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলেন, নবান্নে বিমান বসুদের ফিশফ্রাই সহযোগে আপ্যায়ন করে তাঁদের ‘দল সামলানো’র পরামর্শ দিয়েছিলেন, পুরভোটের পরে তাঁর গলাতেই এখন অন্য সুর। দু’দিন আগেই বিধানসভায় দাঁড়িয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বলেছেন, আগামী বিধানসভা ভোটের পরে এমন দিন আসবে, যখন সাইনবোর্ড হাতে নিয়ে সিপিএম কর্মীদের বলতে হবে ‘আমরা আর সিপিএম করি না’! ঘটনাচক্রে, তার পরের রাতেই কলকাতা পুরসভার ৯১ নম্বর ওয়ার্ডের সিপিএম কাউন্সিলরের বাড়িতে হামলা হয়েছে। যে ঘটনায় অভিযোগের তির শাসক দলের দিকেই। আর ঘটনাস্থল যে এলাকার, সেই কসবা শাসক দলের সাংগঠনিক স্তরে নিয়ন্ত্রণ করা হয় সরাসরি তৃণমূল ভবন থেকেই!

কসবা থানায় দায়ের করা অভিযোগে সিপিএম কাউন্সিলর অন্নপূর্ণা দাস জানিয়েছেন, বাড়ি ভাঙচুর, ইট-পাথর দিয়ে হামলা থেকে শুরু করে তাঁকে খুন করে উপনির্বাচন করানোর হুমকিও দেওয়া হয়েছে। এমনকী, উপনির্বাচন হলে তৃণমূলের তরফে সুজাতা গুপ্ত সেখানে প্রার্থী হবেন বলেও রাতে কাউন্সিলরের বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে হুমকি দিয়ে গিয়েছে দুষ্কৃতীরা! তৃণমূল অবশ্য এই ঘটনার সঙ্গে তাদের দলের কোনও যোগ নেই বলেই দাবি করেছে। শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের তরফে আরও জানানো হয়েছে, রাজনৈতিক রং না দেখেই দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে পুলিশ-প্রশাসন। যদিও কার্যক্ষেত্রে রবিবার রাত পর্যন্ত কাউকে ধরতে পারেনি পুলিশ। তবে ঘটনার সঙ্গে দলের যোগাযোগ অস্বীকার করলেও দলের অন্দরে তৃণমূল নেতাদের একাংশ মানছেন, মুখ্যমন্ত্রী-সহ একেবারে শীর্ষ স্তর থেকে সাম্প্রতিক নানা মন্তব্যে স্থানীয় স্তরে শাসক দলের বাহিনী মনে করছে বিরোধী তথা বামেদের মুছে দিতে হবে! দলের একাংশের আশঙ্কা, উপর থেকে রাশ টানা না হলে বিধানসভা ভোটের আগে এমন আরও ঘটবে।

Advertisement

এমন ঘটনা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কার পিছনে সদ্য অনুষ্ঠিত পুরভোট থেকে উঠে আসা রাজনৈতিক সমীকরণই বড় কারণ বলে মনে করছে বিরোধী বাম এবং শাসক তৃণমূলেরও একাংশ। কলকাতা পুরসভায় গত মাসের নির্বাচনেই ৯১ নম্বর ওয়ার্ডে জিতেছেন সিপিএমের অন্নপূর্ণাদেবী। কেন সদ্য নির্বাচিত কাউন্সিলরকে হামলার মুখে পড়তে হয়েছে, তার নির্দিষ্ট কারণ কোনও মহল থেকেই জানা যায়নি। তবে সিপিএমের দাবি, পুরভোটে বামেদের রক্তক্ষরণ বন্ধ হওয়াই এমন আক্রমণের কারণ। শিলিগুড়িতে জয়ের পরে রাজ্য জু়ড়েই বিধানসভা ভোটের আগে বামেরা আবার পুনরুজ্জীবনের স্বপ্ন দেখছে। মাত্র দু’দিন আগেই এবিপি আনন্দ-এ সি নিয়েলসেনের যে যৌথ সমীক্ষার ফল সামনে এসেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, এখনই ভোট হলে রাজ্যে তৃণমূল পেতে পারে ৩৬% ভোট। আর বামেদের ঝুলিতে আসতে পারে ৩৩%। অর্থাৎ তৃণমূলের সঙ্গে বামেদের ভোটের ফারাক কমে আসার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। সিপিএম নেতৃত্বের দাবি, যত দিন যাবে, তত এই আক্রমণের মাত্রা বাড়বে। এবং সে কথা মাথায় রেখেই বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র দলীয় কর্মীদের প্রতি বার্তায় জানিয়েছেন, ‘‘আতঙ্ক ঝেড়ে ফেলে পথে নেমে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন।’’ সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুজন চক্রবর্তীর অভিযোগ, ‘‘দখলের রাজনীতি করছে তৃণমূল। মানুষের রায়ের উপরে তাদের আস্থা নেই!’’ পাশাপাশিই শাসক দলের একাংশের মত, স্বয়ং দলনেত্রী যে ভাবে সর্বত্র বিরোধীদের ধূলিসাৎ করে নিজেদের হাতে সব ক্ষমতা নেওয়ার লক্ষ্যে চলছেন, তার জেরেই স্থানীয় স্তরে নানা অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটছে।

তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় কসবার ঘটনায় শাসক দলের যোগ মানতে চাননি। তাঁর মন্তব্য, ‘‘যে দলের লোকজনই জড়িত থাকুক না কেন, প্রশাসন তাদের কাজ করবে। অভিযুক্তেরা যে দলেরই হোক, দোষ প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

ঠিক কী ঘটেছিল কসবায়? অন্নপূর্ণাদেবীর অভিযোগ, শনিবার রাত ১টা নাগাদ জনাতিনেক দুষ্কৃতী তাঁর জহুরা বাজার এলাকার বাড়িতে ভাঙচুর চালায়। হামলাকারীরা সবাই তৃণমূল আশ্রিত বলে কাউন্সিলরের অভিযোগ। আতঙ্কে শৌচাগারে ঢুকে কাউন্সিলর ফোন করেন কসবা থানায়। তবে পুলিশ আসার আগেই ভাঙচুর চালিয়ে পালায় দুষ্কৃতীরা। নিজের বাড়িতে বসে এ দিন বছর ষাটের অন্নপূর্ণাদেবী বলেন, ‘‘বাড়িতে অসুস্থ, বৃদ্ধ দাদা ও দিদি ছিলেন। রাতে দরজা ভাঙার শব্দে জেগে যাই। বাইরে তখন তাণ্ডবের সঙ্গে চলছে গালিগালাজ। এক দুষ্কৃতী বলছে, ‘তোকে মেরে ফের নির্বাচন করব’! কোনও মতে বাথরুমে গিয়ে মোবাইলে ফোন করি প্রাক্তন কাউন্সিলর দীপঙ্কর দে-কে। ঘটনাটি জানাই কসবা থানাতেও।’’ অন্নপূর্ণাদেবীর অভিযোগ, ‘‘থানায় ফোন করার প্রায় ১৫ মিনিট পরে পুলিশ আসে। ততক্ষণে দুষ্কৃতীরা চলে গিয়েছে।’’ পুলিশ এসে কী করল? অন্নপূর্ণাদেবীর অভিযোগ, ‘‘পুলিশ এসে বাড়ির মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইট, পাথর সরিয়ে ফেলে। এর পরে তারা ঘটনাটি সংবাদমাধ্যমকে জানাতে নিষেধ করে!’’

কাউন্সিলরের বক্তব্য, রাতে পুলিশ জানায়, বাড়ির সামনে পুলিশ-পাহারা দেওয়া হবে। কিন্তু রবিবার সারা দিনে পুলিশের দেখা পাননি অন্নপূর্ণাদেবী। লোকসভা ভোটের সময়েও তাঁর উপরে এক বার আক্রমণ হয়েছিল। পুলিশ ব্যবস্থা না নিলে বাড়িতে তিন জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা মিলে কী ভাবে থাকবেন, ভেবেই আতঙ্কিত অন্নপূর্ণাদেবী।

কাউন্সিলরের বাড়িতে হামলার প্রতিবাদে এ দিন কসবায় মিছিল করে কসবা থানায় দাবিপত্র দিয়েছে বামফ্রন্ট। বাম নেতাদের অভিযোগ, পুলিশকে কাজ করতে বাধা দিচ্ছেন তৃণমূল নেতারাই। কলকাতা পুরসভার ১০ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান তপন দাশগুপ্ত অবশ্য বলেন, ‘‘কাউন্সিলর অন্নপূর্ণা দাস প্রচারে আসার জন্যই এ সব মিথ্যা অভিযোগ করছেন!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন