প্রাণকুমার চক্রবর্তী
শাসক দলের হিসেবনিকেশ দেখে অডিটরের দেওয়া শংসাপত্র।
কাগজে-কলমে তিনি তৃণমূল কংগ্রেসের অডিটর। চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট প্রাণকুমার চক্রবর্তী। গত চার বছর (২০১০-২০১৪) নির্বাচন কমিশন ও আয়কর দফতরে যে অডিট রিপোর্ট পেশ করেছে শাসক দল, তাকে শংসাপত্র দিয়েছে তাঁর সংস্থা ‘পি কে চক্রবর্তী অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’।
অথচ প্রাণকুমারবাবুর পরিবারের লোকজন দাবি করছেন, গত চার বছর প্রাণকুমারবাবু অডিটের কাজই করেননি। তাঁর অফিসও বন্ধ। তিনি অ্যালঝাইমার্স রোগে ভুগছেন। শুধু পরিবারের দাবি নয়, বাড়িতে গিয়ে প্রাণকুমারবাবুর সঙ্গে কথা বললেই ধরা পড়ে তাঁর স্মৃতিলোপের লক্ষণ!
এমন এক জন মানুষ চার বছর ধরে কী করে শাসক দলের অডিট করলেন? কারা তাঁকে দিয়ে কাজ করালেন? অথচ অডিট রিপোর্টে স্পষ্টই রয়েছে ‘পি কে চক্রবর্তী অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’-এর নাম। রয়েছে অডিটরের সই। সইয়ের উপরে গোটা গোটা করে লেখা রয়েছে, ‘আমি অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেসের ব্যালান্স-শিট পরীক্ষা করে দেখেছি, সমস্ত ঠিক রয়েছে।’ ছাপানো লেটার-হেডে অফিসের ঠিকানা, ফোন নম্বর সবই রয়েছে। কিন্তু সেই নাম-ধাম-ফোন নম্বরই যেখানে পৌঁছে দিচ্ছে, সেটা বৃদ্ধ রুগ্ণ প্রাণকুমারবাবুর বাড়ি। যিনি এক সময় পেশাদার চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন ঠিকই। কিন্তু গত চার বছর ধরে প্রায় শয্যাশায়ী। তার আগেও তৃণমূলের হয়ে অডিটের কাজ কোনও দিন করেননি বলেই পরিবারের দাবি।
লেটার-হেডে দেওয়া ঠিকানা ধরে সোমবার বিকেলে পৌঁছনো গিয়েছিল বাঘাযতীনের কাছে রিজেন্ট এস্টেট লাগোয়া বাপুজি নগরে। তিনতলার ফ্ল্যাটের দরজা খুলে চক্রবর্তীবাবুর খোঁজ করতেই স্ত্রী কল্পনা চক্রবর্তী বললেন, ‘‘উনি অসুস্থ। কথা বলতে পারবেন না।’’ পরিচয় দিয়ে বলা হল, একটু জরুরি প্রয়োজন ছিল। এ বার ঘরের ভিতরে ডেকে নেন কল্পনাদেবী। সেখানেই দেখা হল প্রাণকুমার চক্রবর্তীর সঙ্গে।
সরাসরিই প্রশ্নটা করা গেল। ‘‘আপনি কি গত কয়েক বছর ধরে তৃণমূল কংগ্রেস দলের হিসেবপত্র পরীক্ষা করছেন?’’ ঘাড় নাড়েন বৃদ্ধ। ‘‘হ্যাঁ। ক্যালকাটা জুয়েলার্স-এর অডিট করছি অনেক দিন ধরে!’’ উত্তরটা শুনে অবাক হয়েছি বুঝে পাশ থেকে কল্পনাদেবী বললেন, ‘‘বললাম না, উনি অসুস্থ। অ্যালঝাইমার্স রোগের কথা শুনেছেন? গত চার বছর ধরে সেই রোগের শিকার উনি।’’ এটা কোন সাল? প্রাণকুমারবাবু বলেন, ‘‘১৯৩৮।’’ কোন মাস ? একটু থেমে, ‘‘সেপ্টেম্বর।’’ আপনার বয়স কত ? উত্তর আসে, ‘‘৩৮’’।
প্রাণকুমারবাবুকে যা-ই জিজ্ঞাসা করা হয়, উনি তাতেই সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়েন। কিন্তু কল্পনাদেবী জোর দিয়ে দাবি করলেন, ‘‘আমি বলছি উনি কখনও তৃণমূল কংগ্রেসের হিসেব পরীক্ষা করেননি। আগে যখন সক্ষম ছিলেন, তখন ছোটখাটো গয়নার দোকান, চালকল — এ সবের অডিট করতেন।’’
কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেস বিভিন্ন জায়গায় যে অডিট রিপোর্ট পেশ করেছে, তার সঙ্গে তো ‘পি কে চক্রবর্তী অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’-এর -হেডেই শংসাপত্র জমা দেওয়া হয়েছে? নীচে সই-ও রয়েছে। সংস্থার ঠিকানা হিসেবে এই বাড়িরই উল্লেখ রয়েছে। কল্পনাদেবী জানান, কর্মক্ষম অবস্থায় এই বাড়িতেই একতলায় একটি ঘরে প্রাণকুমারবাবুর দফতর ছিল। চার বছর ধরে তালাবন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। তা হলে তৃণমূলের অডিট রিপোর্টে প্রাণকুমারবাবুর সই কোথা থেকে এল? স্ত্রীর কথায়, ‘‘ওঁর তো নিয়মিত চিকিৎসা চলছে। উনি কী করে সই করবেন? ব্যাঙ্কের লেনদেনও বন্ধ।’’ ছেলে সন্দীপন বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত। তিনি বাড়িতে ছিলেন না। কল্পনাদেবী তাঁকে ফোনে ধরলেন। সন্দীপন বললেন, ‘‘এমন তো হওয়ার কথা নয় ! বাবার অফিসের কাগজপত্র অন্য কারও কাছে ছিল বলেও তো কখনও শুনিনি।’’
তা হলে এমনটা কী করে হতে পারে? তৃণমূলের প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়কে এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি অডিটর পি কে চক্রবর্তীর পুরো নাম বলতে পারেননি। তাঁর কথায়, ‘‘আমি অডিটরকে চিনি না। আমি এক জন চক্রবর্তীর হাতে হিসেবের কাগজপত্র দিয়ে এসেছি, তিনি অডিটরের ক্লার্ক।’’
শাসক দলের হিসেবনিকেশ দেখে অডিটরের দেওয়া শংসাপত্র।
প্রাণকুমারবাবুর কাছে কি ‘চক্রবর্তী’ নামে কোনও ক্লার্ক কাজ করতেন? কল্পনাদেবী জানান, বছর চারেক আগে যখন প্রাণকুমারবাবু আর কাজ করতে পারছিলেন না, তখন শেষের দিকে রাণু (পদবী মনে করতে পারেননি) নামে এক জন মহিলা কয়েক দিন কাজ চালান। তার পরে তিনিও চলে যান। তখন থেকেই পাকাপাকি ভাবে তালা পড়ে যায় ‘পি কে চক্রবর্তী অ্যান্ড অ্যসোসিয়েটস’-এ। তা হলে মুকুল রায় কথিত ‘ক্লার্ক চক্রবর্তী’ কে ? উত্তর জানা নেই সন্দীপনের। কল্পনাদেবীও জানান, চার বছর ধরে বাড়িতেই বন্দি তাঁর স্বামী। সোদপুরে প্রাণকুমারবাবুর এক আত্মীয় চিকিৎসক। তাঁর কাছেই চিকিৎসা চলছে নিয়মিত। সেই চিকিৎসকের সঙ্গে অবশ্য যোগাযোগ করা যায়নি এ দিন। তবে স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ তৃষিত রায় জানাচ্ছেন, প্রাণকুমারবাবুর যা অবস্থা, সেটাকে অ্যালঝাইমার্সের চরম স্তর বলা যেতে পারে। এ রকম ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক কাজ করে না। অডিটের কাজ তো দূরের কথা, খাওয়া-ঘুম-প্রাতঃকৃত্য ছাড়া কোনও কাজই করা যায় না।
তা হলে অডিটের কাজ করল কে? কী বলছেন তৃণমূল নেতৃত্ব? দলের মহাসচিব ও রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘আমি কখনওই অডিটের বিষয়টা দেখিনি। ২০১৪ সাল পর্যন্ত মুকুলই সব দেখত। চক্রবর্তী বলে এক জনের নাম বারবার বলত। তিনি কে, তা জানি না।’’ ‘পি কে চক্রবর্তী অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’ নামে কোনও অডিট সংস্থার নামও তিনি শোনেননি বলে দাবি করেন পার্থবাবু। মুকুল-ঘনিষ্ঠ শিবিরেরও বক্তব্য, তৃণমূল ভবনে জনৈক ‘চক্রবর্তী’ই বিষয়গুলো দেখাশোনা করতেন। এই চক্রবর্তীর সঙ্গে ‘পি কে চক্রবর্তী অ্যান্ড অ্যসোসিয়েটস’-এর সম্পর্ক তবে কী? প্রাণকুমারবাবুর বকলমে কি তাঁর সংস্থার প্যাড ব্যবহার করে অন্য কেউ অডিট করে যাচ্ছেন?
উত্তর নেই। সন্দীপন জানিয়েছেন, তিনি আইনজীবীদের সঙ্গে এই নিয়ে আলোচনা করবেন।