নিয়ন্ত্রণ ফেরাতে সাঁড়াশি কৌশল

শান্তি মিছিলের সঙ্গেই পুলিশি প্রস্তুতি ভাঙড়ে

ভাঙড়ে আন্দোলনকারী নকশাল নেতারা চেয়েছিলেন, সরকার আলোচনার টেবিলে আসুক। সেখান থেকেই রফাসূত্র বের হোক। যাতে কৃষকদের কাছে তাঁদেরও মুখরক্ষা হয়। কিন্তু ‘বহিরাগতদের’ কোনও শর্তেই রাজি নন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:২২
Share:

ভাঙড়ে রাস্তা থেকে গাছের গুঁড়ি সরাচ্ছেন রাজারহাটের বিধায়ক সব্যসাচী দত্ত। মঙ্গলবার সামসুল হুদার তোলা ছবি।

ভাঙড়ে আন্দোলনকারী নকশাল নেতারা চেয়েছিলেন, সরকার আলোচনার টেবিলে আসুক। সেখান থেকেই রফাসূত্র বের হোক। যাতে কৃষকদের কাছে তাঁদেরও মুখরক্ষা হয়। কিন্তু ‘বহিরাগতদের’ কোনও শর্তেই রাজি নন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বরং তাঁর কঠোর অবস্থান, বহিরাগতদের এমন শিক্ষা হোক, যাতে কৃষকদের অযথা ক্ষেপিয়ে তুলে ভবিষ্যতে আর কেউ কোনও উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ আটকে দিতে না পারে। মুখ্যমন্ত্রীর সেই দর্শন মেনেই এ বার অগ্নিগর্ভ ভাঙড়ে শান্তি ফেরাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল সরকার ও শাসক দল।

Advertisement

এক দিকে রাজারহাটের বিধায়ক সব্যসাচী দত্তর নেতৃত্বে মঙ্গলবার ভাঙড়ে শান্তি মিছিল করল তৃণমূল। পাওয়ার গ্রিড সংলগ্ন টোনা মৌজায় গ্রামের রাস্তায় আন্দোলনকারীদের গড়া একের পর এক অবরোধ নিজে হাতে ভেঙে দিলেন সব্যসাচী। আবার আন্দোলনকারীরা যাতে নতুন করে অশান্তি পাকাতে না পারেন, সে জন্য এ দিন দুপুরের পর থেকে তিন দিক থেকে ভাঙড়কে ঘিরে ফেলল কমব্যাট ফোর্স-সহ বিশাল পুলিশ বাহিনী। প্রশাসন ও রাজনৈতিক সূত্রের মতে, ভাঙড়ে শান্তি ফেরাতে এ ধরনের মিছিল যেমন আপাতত চলবে, তেমনই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে অচিরেই গ্রেফতার করা হতে পারে নকশাল নেতাদের।

সরকারের তরফে শান্তি ফেরানোর এই ‘বহর’ দেখে এ দিন ফোঁস করেছেন নকশাল নেতারা। সিপিআই(এমএল) রেড স্টারের নেতা অলীক চক্রবর্তী বলেন, ‘‘এ তো সন্ত্রাস! জেলাশাসক আশ্বাস দিয়েছিলেন প্রশাসনের উপরের সারির নেতা ভাঙড়বাসীর সঙ্গে কথা বলবেন। কিন্তু দুপুর থেকেই দেখছি পুলিশ ও জল্লাদ বাহিনী এলাকা ঘিরে ফেলেছে। আমাদের আশঙ্কা, ভাঙড় দ্বিতীয় নন্দীগ্রাম হতে চলেছে!’’

Advertisement

ক’বছর আগে গণধর্ষণ ও খুনের ঘটনার জেরে কামদুনি যখন উত্তপ্ত, তখন সেখানে দলীয় নিয়ন্ত্রণ ফেরানোর দায়িত্ব বর্তেছিল সব্যসাচীর উপরে। দলবল নিয়ে কামদুনিতে ঢুকেছিলেন তিনি। পথের ধারে বাঁশের মাচায় বসে জনসংযোগের পাশাপাশি খিচুড়ি রেঁধে খাওয়াদাওয়া করেছিলেন সব্যসাচী। কার্যত হাতের বাইরে চলে যাওয়া ভাঙড় পুনর্দখলের লক্ষ্যেও অনেকটা সেই পথে হেঁটেছেন তিনি। এ দিনের শান্তি মিছিলে তৃণমূলের কোনও পতাকা ছিল না। দুই নিরাপত্তা রক্ষীকে নিয়ে মিছিলের শুরুতেই ছিলেন রাজারহাটের বিধায়ক। সঙ্গে রাজারহাট, নিউটাউন এলাকার মাটি-সিন্ডিকেটের পরিচিত বহু মুখ।

দুপুর আড়াইটে নাগাদ রাজারহাট থেকে ভাঙড়ে ঢোকে ওই মিছিল। তার পর পাওয়ার গ্রিড সংলগ্ন মাছিভাঙা, খামারাইট, টোনা, উড়িয়াপাড়া হয়ে এগিয়ে যায়। পাঁচ দিন আগে মাছিভাঙায় রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে তৃণমূল নেতা ও পুলিশের পথ আটকেছিলেন আন্দোলনকারীরা। এ দিন মাছিভাঙায় ঢুকে সব্যসাচী নিজে হাতে সেই গুঁড়ি রাস্তা থেকে সরান। কোথাও আবার রাস্তার উপর গড়ে তোলা ইটের অস্থায়ী পাঁচিল ভেঙে দেন তাঁর অনুগামীরা। রাস্তার পাশে ঝুলিয়ে রাখা পুলিশের উর্দিও সরিয়ে ফেলা হয়। পরে পুকুরে ও নয়ানজুলিতে পড়ে থাকা পুলিশের ভাঙা-পোড়া গাড়ি ক্রেন দিয়ে তোলার ব্যবস্থা করেন সব্যসাচী। এই শান্তি মিছিল যখন চলছে, তখনই নতুনহাটের মাঠে জমায়েত করেছিলেন আন্দোলনকারীরা। নকশাল নেতারাও সেখানে ছিলেন। পরে রাতের দিকে মাছিভাঙা গ্রামে একটি রাস্তা কাটেন আন্দোলনকারীরা। তবে তা নিছকই প্রতীকী প্রতিবাদ বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ, গ্রামের ভিতরের ছোট ওই রাস্তায় তেমন গাড়ি চলাচল করে না।

স্থানীয় এক তৃণমূল নেতার দাবি, মঙ্গলবারের ‘অ্যাকশনের’ জন্য সোমবারই জল মাপা হয়ে গিয়েছিল। এমনিতেই রাস্তা অবরোধকে কেন্দ্র করে গ্রামবাসীদের একাংশের অসন্তোষ বাড়ছিল। সোমবার নতুনহাটে সভা করার পর নকশাল নেতারা শ্যামনগর মোড়ে রাস্তা অবরোধ করতে গিয়ে বাধা পান। তা ছাড়া, ইটভাটার মালিকরাও সম্প্রতি কয়েকটি জায়গায় অবরোধ হঠিয়ে দেন। পরিস্থিতি আঁচ করে নকশাল নেতারা সোমবার থেকেই পথ অবরোধের কৌশল কিছুটা শিথিল করতে শুরু করেছিলেন। প্রশাসন ও শাসক দল সেই সুযোগটাই নিয়েছে।

চাপের মুখে নরম হওয়ার যে ইঙ্গিত নকশাল নেতারা দিয়েছেন, তাতেও সুবিধা হয়েছে প্রশাসনের। ওই নেতারা এ দিনও বারবার সরকারকে বার্তা পাঠিয়েছেন বলে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সূত্রে খবর। তাঁদের তরফে মানবাধিকার কর্মী সুজাত ভদ্র জেলাশাসকের সঙ্গে কথা বলেন। তৃণমূলের এক শীর্ষ সারির নেতা জানান, নকশাল নেতারা ক’দিন আগে মুকুল রায়ের সঙ্গে দেখাও করেছিলেন। তাঁদের প্রস্তাব ছিল, ভাঙড়ের তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হোক এবং তাঁকে ৬ মাসের জন্য দল থেকে সাসপেন্ড করা হোক। সরকার ও তৃণমূল এই পদক্ষেপ করলেই তাঁরা অবরোধ তুলে নেবেন। কারণ, কোনও রকম রাজনৈতিক মুখরক্ষা ছাড়া তাঁদের পক্ষে আন্দোলন প্রত্যাহার করায় অসুবিধা রয়েছে।

কিন্তু তাঁদের এই শর্ত মানতে চাননি মমতা। কারণ, তিনি মনে করেন এটা করলে তা ভবিষ্যতের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। বরং যে কোনও মূল্যে শান্তি ফেরানোর নির্দেশ দেন তিনি। এই পরিস্থিতিতে নকশাল নেতাদের গ্রেফতার করা হতে পারে বলেও জানাচ্ছে প্রশাসনের সূত্র।

পুলিশ সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে, গ্রামে ঢুকে নকশাল নেতাদের গ্রেফতার করা হবে না। কারণ, সে ক্ষেত্রে তাঁরা গ্রামবাসীদের ক্ষেপিয়ে তুলে অশান্তি পাকাতে পারেন। বরং ওঁরা গ্রাম থেকে বেরনোর চেষ্টা করলেই গ্রেফতার করা হতে পারে। সেটা আজ হোক বা কাল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন