মুখ্যমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা। বক্সার ২৮ মাইল বস্তিতে রবিবার নারায়ণ দে-র তোলা ছবি।
দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উত্তরবঙ্গে পা দেওয়ার আগের রাতেই তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে উত্তপ্ত হয়ে উঠল কোচবিহারের দিনহাটা। সোমবার মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক সভা সফল করার জন্য শনিবার রাতে মিছিল করছিল তৃণমূলেরই দুই গোষ্ঠী। একটি মিছিল ছিল সদ্য তৃণমূলে যোগ দেওয়া দিনহাটার বিধায়ক উদয়ন গুহের অনুগামীদের। অন্যটিতে ছিলেন দলের কোচবিহার জেলা সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষের অনুগামীরা। সেই সময়ে দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে দু’পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন বলে তৃণমূল সূত্রেই খবর। তাঁদের চার জনকে দিনহাটা মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। তাঁরা সকলেই উদয়নপন্থী বলে পরিচিত।
উদয়নবাবুর ফরওয়ার্ড ব্লক ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পর থেকেই দিনহাটায় উত্তেজনা ছিল। সে কারণে, দলীয় সূত্রের খবর, এ বার দলনেত্রীর উত্তরবঙ্গ সফরের সময় দিনহাটায় তাঁকে একটি দলীয় জনসভা করারও অনুরোধ করা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত তেমন কোনও সভা হচ্ছে না। কোচবিহারে এ বারের সফরে মমতার একটিই সভা রয়েছে। সোমবার গুমানিহাট এলাকায় তিনি প্রশাসনিক সভাটি করবেন। এই এলাকাটি বনমন্ত্রী বিনয় বর্মনের শক্ত ঘাঁটি বলে পরিচিত।
দলীয় সূত্রের খবর, দলনেত্রীর সফরের একদিন আগে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে চলে আসায় অস্বস্তিতে পড়েছে তৃণমূল। ফের যাতে কোনওরকম গণ্ডগোল না ঘটে সে ব্যাপারে দুই নেতাকেই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। রবীন্দ্রনাথবাবুও এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে ক্ষুব্ধ সহকর্মীদের জানিয়ে দেন, ‘‘উদয়নবাবুকে দলনেত্রী দলে নিয়েছেন। সে জন্য সবাই মিলেমিশে কাজ করতে হবে।’’ পরে রবীন্দ্রনাথবাবু বলেন, “একটু ভুল বোঝাবুঝি থেকে দলের কর্মীদের মধ্যে বচসা হয়। আলোচনার মাধ্যমে তা মিটিয়ে নেওয়া হবে।” উদয়নবাবু গোষ্ঠী সংঘর্ষ মানতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, “কিছু সমাজবিরোধী আমাদের কর্মীদের উপরে হামলা করেছে।” কোচবিহারের পুলিশ সুপার রাজেশ যাদব বলেন, “দুটি অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে।”
উদয়নকে যে ভাবে রাতারাতি বিমানবন্দরে ডেকে পাঠিয়ে দলে নেওয়া হয়েছিল, তা নিয়ে দলে গোড়া থেকেই অস্বস্তি ছিল। দলের শীর্ষ নেতারা ঠিক করেছিলেন এই অস্বস্তি কাটাতে নভেম্বরে কোচবিহারে গিয়ে বৈঠক করে বিষয়টি সামলাবেন। কিন্তু তার পরে খোদ মমতারই ওই এলাকায় যাওয়ার কথা স্থির হয়ে যাওয়ায় সেই সুযোগ তাঁরা পাননি। শনিবারের ঘটনার পরে তাই পরিস্থিতি নিয়ে দলের শীর্ষ নেতারাও আর মুখ খুলতে নারাজ।
তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর যেখানে গণ্ডগোল হয়, তার কাছেই দলের দিনহাটা-২ ব্লক সভাপতি মীর হুমায়ন কবীরের বাড়ি। তিনি রবীন্দ্রনাথবাবুর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। উদয়নবাবু যখন দলে যোগ দেন, তখন তার প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন মীর। তা নিয়ে দুই পক্ষের সমর্থকদের চাপানউতোর চলছিল। ওই গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান সাজিদুল হক অবশ্য উদয়নবাবুর ঘনিষ্ঠ। ওই গ্রামের ফরওয়ার্ড ব্লক কর্মীদের বড় অংশ উদয়নবাবুর অনুগামী বলে পরিচিত।
হুমায়ন কবীর গোষ্ঠীর অভিযোগ, শনিবার নয়ারহাট বাজারে হাট বসে। দলনেত্রীর সফরের প্রচারে তৃণমূল কর্মীরা মিছিল করছিল। সেই সময় আচমকা মিছিলের উপরে হামলা চালান উদয়ন অনুগামীরা। ইট, পাথর ছোড়া হয়। ওই এলাকার তৃণমূল নেতা বিশ্বজিৎ নন্দী অবশ্য ঘটনার দায় ফরওয়ার্ড ব্লকের উপরে চাপাতে চেয়েছেন। তিনি বলেন, “ফরওয়ার্ড ব্লকের কর্মীরা গুলিও ছুড়েছিল। কোনওক্রমে প্রাণে বেঁচে গিয়েছি।” হুমায়ুন কবীর যদিও সোজাসুজিই বলেন, ‘‘উদয়নবাবুর ঘনিষ্ঠরাই আমাদের উপরে আক্রমণ করেছে।’’
উদয়নবাবুর অনুগামীদের পাল্টা অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানের প্রচারে তাঁরাই মিছিল করেছিলেন। সে সময় হামলা চালান হুমায়ুন কবীরের লোকজন। সাজিদুল বলেন, “উদয়নবাবুর বিরোধী স্লোগান দিয়ে আমাদের দলেরই কিছু লোক আমাদের মারধর করে। আমাদের মিটিংয়ে যেতে দেওয়া হবে না বলেও হুমকি দেন তাঁরা।”
এ দিন বিকাল পৌনে চারটে নাগাদ বাগডোগরা বিমান বন্দর থেকে হেলিকপ্টারে চেপে বক্সা পাহার গভীর জঙ্গল লাগোয়া আঠাশ মাইল বস্তিতে পৌঁছন মমতা। তাঁর সফর ঘিরে ইতিমধ্যেই নানা বিতর্ক শুরু হয়েছে। তাঁর সফরের জন্য জয়ন্তীতে পর্যটকদের বুকিং বাতিল করার অভিযোগ উঠেছে। হেলিপ্যাডের জন্য গাছ কাটার নালিশও উঠেছে। মুখ্যমন্ত্রী সে সবই উড়িয়ে দিয়ে জয়ন্তীতে পৌঁছে বলেন, ‘‘আমি নিরিবিলিতে থাকব বলে জয়ন্তীকে বেছে নিয়েছি। আমার সফরের জন্য পর্যটকদের কোনও বুকিং বাতিল হয়েছে বলে শুনিনি। আমি পর্যটকদের বিরক্ত করতে চাই না বলেই তো হলংয়ে না থেকে জয়ন্তীকে বেছে নিয়েছি।’’