থমথমে: মহম্মদপুরে পুলিশ প্রহরা।
এলাকায় তিনিই ছিলেন ‘সরকার’।
অভিযোগ, কেউ হুকিং করলে টাকা দিতে হতো তাঁকে। মাছের ভেড়ির ব্যবসা চালাতেও নাকি দিতে হতো নজরানা। এমনকী থানায় অভিযোগ জানানোর আগেও তাঁর কাছেই যেতে হতো বলে দাবি গ্রামবাসীর। তিনি চাইলে, তবেই গ্রামে পুলিশ আসতো।
পূর্ব মেদিনীপুরের ভগবানপুর ১ ব্লকের মহম্মদপুরে শনিবার সকালেও পুলিশ এল সেই তৃণমূলের ‘দাপুটে’ নান্টু প্রধানের সৌজন্যেই। জলাজমিতে পড়ে থাকা নান্টুর রক্তাক্ত দেহ উদ্ধার হল। ২০১৬-এর পঞ্চায়েত ভোটের আগে একবার নান্টু গ্রেফতার হয়েছিলেন। ওডিশার কটকের একটি হোটেল থেকে নান্টু-সহ মোট ৬ জনকে পাকড়াও করেছিল পুলিশ। তবে নান্টুকে বেশিদিন আটকে রাখা যায়নি। জামিন পেয়ে স্বমহিমায় এলাকায় ফিরেছিলেন তিনি।
চাষজমিতে নোনাজল ঢুকিয়ে ভেড়ি বানানোর অভিযোগ নান্টুর বিরুদ্ধে বহুদিনের। তা নিয়ে সংঘর্ষেই তাঁকে মরতে হয়েছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। তৃণমূল নেতৃত্ব বিজেপি ও সিপিএমের দিকে আঙুল তুললেও মহম্মদপুরে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, ‘কুকর্মের শাস্তি তো পেতেই হবে!’
স্থানীয় সূত্রে খবর, বাবার হাত ধরেই নান্টুর রাজনীতিতে আসা। ২০০৩ সালে তৃণমূলের টিকিটে জিতে মহম্মদপুর-১ পঞ্চায়েতের প্রধান হন নান্টুর বাবা চাঁদহরি প্রধান। ২০১৩ সাল পর্যন্ত একটানা ওই পদে ছিলেন তিনি। রাজ্যে পালাবদলের পরে ‘রাজ্যপাট’ যায় নান্টুর হাতে।
ভোটে জিতে তিনি নিজে উপপ্রধান হন। স্ত্রী অপর্ণা হন গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান। আর নান্টুর ভাই পিন্টু ভগবানপুর ১ পঞ্চায়েত সমিতির পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ। নান্টুর শাশুড়িও পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য নির্বাচিত হন। এই ‘পঞ্চায়েত-রাজ’ কায়েমের পরই রাতারাতি বদলে যায় নান্টুর জীবন। যে যুবক একটা সময় কুয়োর চারদিকে বাঁশের বেড়া দেওয়ার কাজ করতেন, তাঁরই ক্রমে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়। দো’তলা বাড়ি, দোরগোড়ায় গাড়ি— রাতারাতি বাড়ে সম্পত্তির বহর।
মায়ের নামে তৈরি করা নান্টু প্রধানের বি এড কলেজ ।
বেশ কয়েক একর জমিতে মা আশালতা প্রধানের নামে পেল্লায় বিএড কলেজও বানিয়েছিলেন নান্টু। তৃণমূলেরই একটি সূত্র জানাচ্ছে, দলের জেলা নেতাদের ‘প্রশ্রয়ে’ গোটা মহম্মদপুরে একচ্ছত্র দাপট চলত নান্টুর। সিভিক ভলান্টিয়ার, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, আশা কর্মী, এমনকী প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগেও কাজে আসত তাঁর সুপারিশ।
সেই নান্টুর মৃত্যুর পরে এ দিন মুখে কুলুপ এঁটেছেন তাঁর পরিজনেরা। সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের বাড়ির ধারেকাছে ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি। এলাকায় পুলিশ ঢুকতেও প্রথমে বাধা দেওয়া হয়েছিল। পরে ঘটনাস্থলে যান কাঁথি, এগরার এসডিপিও, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার-সহ বিশাল পুলিশ বাহিনী।
এ দিন এলাকায় গিয়েছিলেন মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীও। তৃণমূলের তরফে নান্টু খুনে অভিযোগ করা হয়েছে বিজেপি ও সিপিএমের বিরুদ্ধে। যদিও বিরোধী এই দুই দলের নেতারাই বলছেন, জনরোষে মরতে হয়েছে নান্টুকে। বিরোধী শিবিরের কেউ কেউ মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই প্রবাদ, ‘উল্কার মতো উত্থান হলে পতনও হয় উল্কাগতিতে!
নিজস্ব চিত্র