ছিলেন পশ্চিম এবং উত্তর ভারতের আরাধ্য। নামের সঙ্গে হিন্দি বলয়ের সম্ভাষণসুলভ ‘গণেশজি’। অর্থনীতি বদলেছে, বাণিজ্য বদলেছে। সেই সঙ্গেই রাজনীতির টানে এই বাংলায় তিনি এখন ‘গণেশ বাবা’। বছর বছর বাংলার পাড়ায় পাড়ায় লাফিয়ে বাড়ছে তাঁর উপস্থিতি। সেই ধারা মেনে এ বছরও বাংলায় দাপট দেখালেন সিদ্ধিদাতা!
বহু দিন যাবৎ বাঙালির শারদ মরসুমের সূচনা হত বিশ্বকর্মার হাত ধরে। কিন্তু একের পর এক কারখানার ঝাঁপ বন্ধ হয়ে বাংলার সব শিল্পাঞ্চল মরুভূমি হতেই বিশ্বকর্মার জায়গা নিয়ে নিয়েছেন বাবা গণেশ। শুধু নিয়ে নিয়েছেন নয়, ছাপিয়ে গিয়েছেন। কলকাতার পাড়ায় পাড়ায় শুক্রবার দেখা মিলেছে গণেশ পুজোর মণ্ডপের। একই ছবি জেলা শহরগুলিতে, যা আগে ছিল না। কারখানার চৌহদ্দি ছেড়ে বেরিয়ে বিশ্বকর্মা এ ভাবে পাড়ার বারোয়ারি দেবতা হতে পারেননি, যা অতি অল্প সময়ে করে দেখিয়েছেন গণেশ।
গণেশ চতুর্থী পালন আম উৎসব হয়ে ওঠার পিছনে বড় কারণ রাজ্যের শাসক দলের সোৎসাহ অংশগ্রহণ। গত কয়েক বছরের মতো এ দিনও তৃণমূল ভবনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে সঙ্কল্প করে গণপতির আরাধনা করেছেন মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। বাঙালির সব চেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপুজো এখন তৃণমূল নেতাদের দখলে। গণেশ পুজোতেও তার ব্যতিক্রম নেই। শোভনদেব থেকে শশী পাঁজা, একাধিক পুজোয় ব্যস্ত। শুধু হাবড়াতেই ১১টা গণেশ বন্দার উদ্বোধন হয়েছে মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের হাত ধরে। বিধাননগরে গণেশ আরাধনায় সামিল মেয়র সব্যসাচী দত্তও।
প্রশ্ন হল, এই গণ-হারে গণপতি পুজোর জন্য তহবিল কোথা থেকে আসছে? বা়ড়ি বাড়ি গিয়ে গণেশ পুজোর চাঁদা কাটার চল তো চোখে পড়ছে না। খোঁজ করলে দেখা যাচ্ছে, গণেশ আছেন অনেক রকম— নেতাদের গণেশ, সিন্ডিকেটের গণেশ, প্রোমোটারের গণেশ, ব্যবসায়ীর গণেশ। শিল্প নেই, চাকরি নেই। বিষণ্ণতার এই আবহে যুব সমাজকে মাতিয়ে রাখার নিত্য নতুন উৎসব চাই। সেই তালিকায় দিব্যি মানিয়ে নিয়েছেন গজানন! তাঁর চাহিদাও অল্প। দু’টো লাড্ডু পেলেই হল! বাকিটা ভক্তদের উচ্ছ্বাস আর উন্মাদনা।
আরও পড়ুন:
তিন তালাক রদে জয় দেখছেন বহু কাজিই
রাজ্যের মন্ত্রী সাধন পাণ্ডে যুক্তি দিচ্ছেন, ‘‘সমৃদ্ধির দিকে তাকিয়ে বাংলায় গণেশ পুজো বাড়ছে। সিদ্ধিদাতাকে পুজো করলে ভাল হবে, এটাই বিশ্বাস। আর ধর্মাচরণকে গুলিয়ে দিতে চাইলে কী হয়, গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি দেখেছে!’’ সাধনবাবুর বাড়িতেই গণেশ পুজো হয় তাঁর মেয়ের উদ্যোগে। একই ভাবে তৃণমূল বিধায়ক তথা বিধাননগরের মেয়র সব্যসাচীবাবুর মত, ‘‘সনাতন সিদ্ধিদাতার পুজো ছাড়া অন্য কোনও কিছুই সম্ভব নয়।’’ আবার জ্যোতিপ্রিয়বাবুরা মানছেন, তাঁরা এ বার গোটা উত্তর ২৪ পরগনা ছেয়ে দিয়েছেন গণেশে। বিজেপি-কে কোথাও দাঁত ফোটানোর সুযোগ দেওয়া যাবে না, বলেই দেওয়া হয়েছিল জেলার নেতা-কর্মীদের।
বস্তত, সেই রামনবমীর পরে হনুমান জয়ন্তী, রথযাত্রা বা এখন গণেশ পুজো— বিজেপি আর এঁটে উঠতে পারছে না তৃণমূলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায়। বিজেপি-র যুক্তি, সব উৎসবেই মাততে হবে, তার কোনও মানে নেই। দলের সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসুর দাবি, ‘‘তৃণমূলের পয়সা তোলার হাতিয়ার হয়েছে গণেশ পুজো। বিজেপি পয়সা তোলার জন্য উৎসব করে না। তারা আদর্শের কারণে করে।’’
তৃণমূল অবশ্য জানে, গণেশের হাত ধরে ভোটের বাক্সে সিদ্ধিলাভ হলে, ক্ষতি কী!