বিধানসভার বাইরে অবস্থান তোলা নিয়ে স্বপনকান্তি ঘোষের সঙ্গে কথা ফিরহাদ হাকিমের।
দলের মধ্যে বিদ্রোহের সুরে তৃণমূলে অস্বস্তি ছিলই। এ বার সরাসরি বিধানসভায় তার প্রভাব এসে পড়ল। দলীয় নেতৃত্বের অস্বস্তি আরও বাড়িয়ে বিধানসভা চত্বরে ধর্নায় বসলেন তৃণমূলের বিধায়ক স্বপনকান্তি ঘোষ। দলেরই একাংশের বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে অভিযোগ নিয়ে তাঁর এই অবস্থান, সেই প্রশ্নে বিধানসভার মধ্যে সরব হলেন বিরোধীরা। বিড়ম্বনায় পড়তে হল শাসক দলকে।
নানা দাবি-দাওয়া বা প্রতিবাদ নিয়ে বিধানসভা চত্বরে, স্পিকার বা কোনও মন্ত্রীর ঘরের সামনে বহু বার ধর্নায় বসেছেন বিরোধী পক্ষের বিধায়কেরা। কিন্তু দলেরই একাংশের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে শাসক দলের বিধায়ক অধিবেশন চলাকালীন বিধানসভার পোর্টিকোয় অবস্থান করছেন, এমন দৃশ্য খুব সুলভ নয়! বিব্রত তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বপনবাবুকে দল থেকে সাসপেন্ড করার কথা ঘোষণা করেছেন। ‘অন্য দলের হাতে তামাক খেয়ে’ স্বপনবাবু এমন কাণ্ড ঘটিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেছেন তাঁরা। কিন্তু তত ক্ষণে স্বপনবাবুর উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে গিয়েছে! দলের একাংশের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তিনি সর্বসমক্ষে আনতে চান। তৃণমূল নেতৃত্ব যে আদৌ সেই অভিযোগকে গুরুত্ব দিতে চান না, বরং তাঁদের মনোভাব যথেষ্ট অসহিষ্ণু এ সবই বুধবার কয়েক ঘণ্টার ধর্নায় প্রকট করে দিতে পেরেছেন সিউড়ির বিধায়ক।
অধিবেশন শুরুর আগেই এ দিন বিধানসভার মূল ভবনে প্রবেশের ফটকের সামনে সিঁড়িতে ধর্নায় বসেন স্বপনবাবু। সঙ্গে বিরাট প্ল্যাকার্ড। তাতে সিউড়ি পুরসভায় জল-প্রকল্পে আর্থিক তছরুপের তদন্ত এবং পানীয় জল ও বস্তিবাসীর জন্য পাকা বাড়ির দাবি। কেন তিনি এ ভাবে ধর্নায়? স্বপনবাবু বলেন, “আমার দল সভায় আমায় কিছুই বলতে দেবে না! তাই এখানে বসেই আমার বক্তব্য জানাচ্ছি, যাতে আমার দল তো বটেই, বিরোধীরাও জানতে পারেন আমি ঠিক না ভুল!” তাঁর সেই চেষ্টা বৃথা যায়নি। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র, কংগ্রেসের পরিষদীয় দলনেতা মহম্মদ সোহরাব, মানস ভুঁইয়া, বিজেপি-র শমীক ভট্টাচার্যেরা দফায় দফায় কথা বলে গিয়েছেন ধর্নারত বিধায়কের সঙ্গে।
বস্তুত, বিধায়কের হয়ে প্রচারপত্র বিলি করছিলেন বলে তাঁর চালককে মার্শাল যে ভাবে আটক করেছিলেন, তা নিয়ে প্রথম সরব হন বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবুই। অধিবেশনে তিনি স্পিকারের কাছে আবেদন জানান, “সভায় ঢোকার সময় সিঁড়িতে দেখলাম, শাসক দলের এক বিধায়ক বসে আছেন। তাঁকে সভায় ডেকে এনে বলতে দেওয়া হোক।” স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য জানান, স্বপনবাবুকে বার্তা পাঠানো হয়েছিল তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য। কিন্তু স্বপনবাবু রাজি হননি। তাই স্পিকারের আর কিছু করার নেই। বামেরা দাবি করে, স্বপনবাবু মুখ্যমন্ত্রীকে একটি চিঠি দিয়েছেন। সেখানে একাধিক মন্ত্রী এবং শাসক দলের নেতার নাম আছে। তাই বিধানসভায় সরকারি বিবৃতি চাই। কংগ্রেস বিধায়কেরাও হইচইয়ে যোগ দেন। পরে আরও এক বার এই বিষয়ে সরব হন বিরোধী বিধায়কেরা।
বিধানসভা চত্বরে ধর্নায় বসেছেন শাসক দলের বিধায়ক স্বপনকান্তি ঘোষ। সহমর্মিতা জানাতে হাজির তিন বিরোধী দলের তিন মুখ।
(বাঁ দিক থেকে) কংগ্রেসের অসিত মিত্র, সিপিএমের সূর্যকান্ত মিশ্র এবং বিজেপির শমীক ভট্টাচার্য। বুধবার।
বাইরে তখন পুরোদস্তুর নাটক! পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিম বিধানসভার সিঁড়িতে গিয়ে স্বপনবাবুকে সভায় আসতে বলেন। জানান, সমস্যা মেটাতে সেখানেই আলাপ-আলোচনা করা যাবে। কিন্তু স্বপনবাবু রাজি হননি। উল্টে বলেন, আড়াই বছর ধরে এই অভিযোগ দলকে জানিয়ে বসে থেকেও কিছু হয়নি! এমনকী, যখন পুুরমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যান, তিনি তখন আবার বাংলাদেশে চলে গিয়েছেন! স্বপনবাবুর এই প্রত্যাখ্যানে কিছুটা উত্তেজিত হয়ে পড়েন পুরমন্ত্রী। শেষ পর্যন্ত খালি হাতেই ফিরতে হয় তাঁকে। বিধানসভার ভিতরে ফিরহাদ বিবৃতি দিয়ে বলেন, “কোনও বিধায়কের যে কোনও প্রশ্ন করার অধিকার আছে। উনি (স্বপন) একটি চিঠি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীকে। মুখ্যমন্ত্রী আমায় নির্দেশ দেন ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। এ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হচ্ছে। জলের ব্যাপারে পুর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মাধ্যমে টেন্ডার হয়ে গিয়েছে। শীঘ্রই কাজ শুরু হবে।” শেষে পুরমন্ত্রী বলেন, “উনি যে অভিযোগ করেছেন, তার তদন্ত হচ্ছে। তার পরেও উনি আজ যা করেছেন, সেটা এক জন বিধায়কের পক্ষে সমীচীন নয় বলে মনে করি।”
দু’ঘণ্টারও বেশি অবস্থানের পরে স্বপনবাবু সংবাদমাধ্যমকে বলেন, সিউড়ির মানুষের কাছে জবাবদিহি করতে হবে বলেই তিনি দুর্নীতির অভিযোগের বিচার চাইছেন। তাঁর কথায়, “আমি জনগণের ভোটে নির্বাচিত। অন্যের দুর্নীতির দায় আমি নিতে যাব কেন? এটা শাসক বা বিরোধী দলের ব্যাপার নয়।” কিন্তু তাঁর এ দিনের আচরণের জন্য দল যদি তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়? স্বপনবাবু তখনই বলে দেন, “সাসপেন্ড করলে কষ্ট পাব। বহিষ্কার করলে খুশি হব! তবে বহিষ্কার করলেও আমি কিন্তু এলাকার বিধায়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করে যাব।” তিনি কি বিজেপি-তে যাবেন? স্বপনবাবুর জবাব ছিল, “আমি বললাম আর অন্য দল নিয়ে নিল, এ ভাবে সব কিছু হয় না! তবে কোনও দরজাই বন্ধ নয়।”
বহরমপুর জাজেস কোর্টের বাইরে হুমায়ুন কবীর।
স্বপনবাবু একতরফা ভাবে তৃণমূলকে গোল দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন দেখে এর পরে আসরে নামেন শাসক দলের নেতৃত্ব। পুরমন্ত্রী ফিরহাদ, আবাসনমন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস এবং কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে পাশে নিয়ে পরিষদীয় মন্ত্রী তথা তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় ঘোষণা করেন, স্বপনবাবুকে অবিলম্বে দল থেকে সাসপেন্ড করা হচ্ছে। তাঁর বিরুদ্ধেও কিছু অভিযোগ দলের কাছে জমা পড়েছে। সে সবেরও তদন্ত হবে। কী অভিযোগ? পার্থবাবু বলেন, “দলের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বাইরে বলব কেন? তবে অন্য দলের উস্কানিতে তিনি যে এমন কাজ করেছেন, বোঝাই যাচ্ছে।” ফিরহাদ সংযোজন করেন, “অন্য দলের হাতে তামাক খেয়ে কথা বলছেন স্বপনবাবু! কেউ যখন মনে মনে তাঁর আনুগত্য পাল্টে ফেলেন, তখন এই রকম নানা অভিযোগই করেন!”
দলের এই সিদ্ধান্তের কথা জেনে স্বপনবাবু আবার পাল্টা খোঁচা দিয়েছেন, “আগে তো সাসপেনশনের চিঠি আসুক! ওই রকম সাসপেন্ড অতীতে অনেকেই হয়েছেন! আর আমার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ, ভয় না দেখিয়ে সব প্রকাশ্যে আনুন!”
তৃণমূল নেতৃত্বের ব্যাখ্যা, বহিষ্কার করলে বিধায়ক থেকে যেতে পারবেন স্বপনবাবু। তার চেয়ে সাসপেন্ড করে তাঁকে ঝুলিয়ে রাখা গেল! যদিও সাসপেন্ড করে যে তাঁর মুখ বন্ধ করা যাবে না, তার ইঙ্গিত এ দিনই পেয়ে গিয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। পাশাপাশিই তাড়া করছে অন্য প্রশ্ন। বিরোধী দলনেতা সূর্যবাবু প্রশ্ন তুলেছেন, “ওঁদের দল কী সিদ্ধান্ত নেবে, সেটা ঘোষণা করার জায়গা কি বিধানসভা? আমাদের দলের বা বামফ্রন্টের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তো আলিমুদ্দিন স্ট্রিট থেকে ঘোষণা হয়।” বিজেপি বিধায়ক শমীকেরও মন্তব্য, “বাম আমলে সরকার, প্রশাসন ও দলের মধ্যে যে একটা সূক্ষ্ম বিভাজন রেখা ছিল, এই জমানায় সেটাও মুছে গিয়েছে! এরা বিধানসভাকেও দলীয় মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করছে।”
মঞ্চই বটে! বিধায়ক তাকে ব্যবহার করছেন দলের বিরুদ্ধে। দল আবার সেই মঞ্চই কাজে লাগাচ্ছে বিধায়কের বিরুদ্ধে। আর তাতে বাড়ছে শাসকের বিড়ম্বনাই!
ছবি: নিজস্ব চিত্র ও রণজিৎ নন্দী।