তৃণমূল ভবনে যোগ দেওয়ার পরে। সোমবারের নিজস্ব চিত্র।
অধীর চৌধুরীর গড়ে আগেই তারা থাবা বসিয়েছে। এ বার নেপাল মাহাতোর শক্ত ঘাঁটিতেও পা ফেলল তৃণমূল। কংগ্রেসে কাঁপুনি ধরিয়ে ঝালদা পুরসভা ‘গিলে’ ফেলার পথে এগিয়ে গেল শাসকদল।
এর আগে গত বছরই ঝালদা ১ পঞ্চায়েত সমিতির কংগ্রেস সদস্যদের ভাঙিয়ে সেই সমিতি দখল করে পুরুলিয়া জেলা কংগ্রেস সভাপতি তথা স্থানীয় বিধায়ক নেপালের ঘাঁটিতে প্রথম বার ধাক্কা দিয়েছিল তৃণমূল। আরও নির্দিষ্ট করে বললে যুব তৃণমূল সভাপতি তথা দলের তরফে পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার পর্যবেক্ষক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। আর এ বার ঝালদা পুরসভা। অথচ ২০১৫ সালের পুর-নির্বাচনে তৃণমূলের ভরা বাজারেও ঝালদায় নিজেদের আধিপত্য বজায় রেখে নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় এসেছিল কংগ্রেস। কিন্তু, সোমবার কংগ্রেসের চার জন-সহ মোট ৭ জন কাউন্সিলর তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় পুরসভার ক্ষমতা বদল এখন সময়ের অপেক্ষা বলেই মনে মনে করা হচ্ছে।
অথচ এই পুরসভায় তৃণমূলের এক জন কাউন্সিলরও নেই। ঠিক যেমনটা হয়েছে মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর ও উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ পুরসভায় এক জন কাউন্সিলর না থাকা সত্ত্বেও সেগুলি দখল করেছে শাসকদল।
ঝালদা শহর তৃণমূল সভাপতি দেবাশিস সেন জানান, কংগ্রেসের প্রদীপ কর্মকার, অনিতাদেবী শর্মা, মিনু কর্মকার, বাবি কান্দু, ফরওয়ার্ড ব্লকের কাঞ্চন পাঠক এবং দুই নির্দল কাউন্সিলর সুরেশ অগ্রবাল ও পঙ্কজ মণ্ডল কলকাতায় তৃণমূল ভবনে গিয়ে শুভেন্দু অধিকারী ও অভিষেকের উপস্থিতিতে শাসকদলে যোগ দিয়েছেন। ভয় ও লোভ দেখিয়ে প্রভাবিত করে তৃণমূল তাঁদের কাউন্সিলরদের নিয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ তুলে জেলা কংগ্রেস নেতৃত্ব দল ভাঙানোর এই রাজনীতিকে ‘রুচিহীন’ বলে তোপ দেগেছেন। কিন্তু, আড়ালে তাঁরাই মানছেন, যা ক্ষতি হওয়ার হয়েই গেল!
ওই সাত কাউন্সিলর তৃণমূলে যাচ্ছেন, এমন জল্পনা সম্প্রতি ঝালদার আনাচে কানাচে শোনা যাচ্ছিল। নেপাল মাহাতোর অভিযোগ, ‘‘নানা ভাবে প্রভাবিত করে কলকাতার একটি হোটেলে আমাদের দলের চার কাউন্সিলর-সহ ওই সাত জনকে নজরবন্দি করে রাখা হয়েছিল। তাঁরা যে নজরবন্দি অবস্থায় রয়েছেন, মোবাইলে কথোপকথনেই তা স্পষ্ট। এর প্রমাণও আছে আমাদের হাতে।’’
উল্লেখ্য, ১২ আসনের ঝালদা পুরসভায় গত বছর ভোটে কংগ্রেস একক ভাবে ৭টি, নির্দল ২টি, ফরওয়ার্ড ব্লক ২টি এবং সিপিএম ১টি আসন পায়। তার আগে ২০১০ সালের পুর-নির্বাচনের পরের পাঁচ বছরে বারবার অনাস্থার জেরে এই পুরসভায় ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে। কখনও বামফ্রন্ট, কখনও কংগ্রেস, কখনও তৃণমূল, কখনও নির্দলের প্রতিনিধি পুরপ্রধানের কুর্সিতে বসেছেন। কিন্তু ঝালদার মানুষ অভিযোগ তুলেছেন, ক্ষমতার এত বার হাতবদলের মাঝে উপেক্ষিত থেকেছে ঝালদার উন্নয়নই।
তাই গত নির্বাচনে জেতার পরে কংগ্রেসের দাবি ছিল, একমাত্র স্থায়ী পুরবোর্ডের হাত ধরে উন্নয়ন আসবে, এই আশাতেই ঝালদার মানুষ তাদের হাতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা তুলে দিয়েছেন। সেই ঝালদায় বছর ঘুরতেই পুরো উলটপুরাণ! এবং ফের হয়তো বিশ বাঁও জলে গেল উন্নয়ন—আশঙ্কা এলাকাবাসীর।
কী ভাবে তৃণমূলের পক্ষে প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হল? ঝালদায় কান পাতলেই শোনা যায় বর্তমান পুরপ্রধান কংগ্রেসের মধুসূদন কয়ালের সঙ্গে প্রাক্তন পুরপ্রধান প্রদীপ কর্মকারের ঠান্ডা লড়াই রয়েছে। গত নির্বাচনের পর দু’জনেই পুরপ্রধানের কুর্সির দাবিদার ছিলেন। কিন্তু দল ‘সিনিয়র’ হিসাবে মধুসূদনবাবুকেই পুরপ্রধান হিসেবে বেছে নেয়। নিমরাজি হয়ে দলের সিদ্ধান্ত মেনে নিলেও ভিতরে ভিতরে ক্ষোভ ছিল প্রদীপবাবুর। পুরসভার অন্দরের খবর, গত এক বছরে পুরসভা পরিচালনার প্রশ্নে নানা সময়ে এই দু’জনের মতবিরোধ হয়েছে। প্রদীপবাবু যখন পুরপ্রধান ছিলেন, সে সময়কার কিছু কাজকর্ম নিয়ে মধুসূদনবাবু প্রশ্ন তোলায় দু’জনের সম্পর্কের তিক্ততা আরও বাড়ে। তবে দ্বন্দ্বের বিষয়টি কখনওই প্রকাশ্যে আসেনি।
অতীতে একাধিক বার দলবদলের নজির রয়েছে প্রদীপবাবুর। সেই ধারাবাহিকতা এ বারও বজায় থাকল। তবে, জোর করে বা প্রভাব খাটিয়ে তৃণমূল তাঁদের নিয়ে গিয়েছে, এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনি। তাঁর দাবি, ‘‘ঝালদার উন্নয়ণের লক্ষ্যে আমরা স্বেচ্ছায় তৃণমূলে গিয়েছি। এর মধ্যে অন্য কোনও ব্যাপার নেই।’’ আর এক প্রাক্তন পুরপ্রধান তথা নির্দল কাউন্সিলর সুরেশ অগ্রবাল একই সুরে বলেছেন, ‘‘এখন আমাদের লক্ষ্য ঝালদার উন্নয়ন।’’ এঁদের সঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের বাঘমুণ্ডির পরাজিত তৃণমূল প্রার্থী সমীর মাহাতোও ছিলেন।
জেলা কংগ্রেস সভাপতি নেপালবাবু বলেন, ‘‘অন্য দল ভাঙিয়ে তৃণমূল যে রাজনীতি করছে, তাকে আর যাই হোক শিষ্টাচারের রাজনীতি বলে না। পুরভোটে ঝালদায় তৃণমূল খাতাও খুলতে পারেনি। যাঁরা গিয়েছেন, তাঁরা ইস্তফা দিয়ে জিতে আসুন, তবে বোঝা যাবে।’’ এই অভিযোগ অবশ্য মানতে চাননি জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো। তিনি বলেছেন, ‘‘প্রভাব খাটিয়ে বা জোর করে মোটেই কাউকে আমাদের দলে আনা হয়নি। যাঁরা তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন, তাঁরা স্বেচ্ছায় এসেছেন।’’