ছেলেটার কান-নাক দিয়ে তখন গলগল করে রক্ত বেরোচ্ছিল। কী ভাবে হাসপাতালে নিয়ে যাব ভাবছি। এ দিকে চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে আমার আর শুভর (কৌশিক পুরকাইত) মা চন্দ্রার। আমরা দু’বোনই গিয়েছিলাম হরিণডাঙা পঞ্চায়েতের পশ্চিমপাড়ায়। যেখানে আমার সোনার টুকরো বোনঝিকে ওরা মোষ-চোর সন্দেহে পেটাচ্ছিল।
মারধর করে যখন ছেলেটা নেতিয়ে পড়েছে, কোনও সাড় নেই, তখন তাপস মল্লিক (হরিণডাঙা পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য) আমাদের হাতে ২০০ টাকা ধরিয়ে বলল, ‘‘যাও এটা নিয়ে হাসপাতালে যাও।’’ ইচ্ছে হচ্ছিল, টাকাটা নিয়ে ওর মুখেই ছুঁড়ে মারি। কিন্তু তখন সে সবের সময় ছিল না। ভয়ও ছিল, ফের না মারধর শুরু করে মরো মরো ছেলেটাকে। আমরা টাকায় হাতও দিইনি। শুভকে নিয়ে রওনা দিই ডায়মন্ড হারবার হাসপাতালের দিকে।
তার আগে বলি, কখন জানতে পারলাম ভয়ঙ্কর ঘটনাটার কথা।
সোমবার রাতে আমার বাড়িতে গৃহপ্রবেশের পুজো ছিল। কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠারও কথা। বোন চন্দ্রা দুপুরের দিকেই চলে এসেছিল। ডায়মন্ড হারবারের যুব কম্পিউটার প্রশিক্ষণ থেকে ক্লাস সেরে শুভ আসে সন্ধের দিকে। তারপরে আমার ছেলে সুমনকে নিয়ে ডায়মন্ড হারবারে অক্ষয় তৃতীয়ার নিমন্ত্রণে যায়। সাড়ে ৮টা নাগাদ বাড়ি আসে।
ওর পরণে সে দিন কালো জামা ছিল। আর সম্ভবত ছাই ছাই রঙের একটা প্যান্ট পড়ে ছিল। বাড়িতে তখন পুজোর আয়োজনে ব্যস্ত আত্মীয়-স্বজন। ভাল করে কথা হয়নি। তবে শুভর একটা ফোন এল মোবাইলে। ওকে দেখলাম কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেল বাড়ির বাইরে।
কথা বলতে বলতে বাড়ি থেকে মিনিট পাঁচেক দূরে একটা শান বাঁধানো বটগাছ তলায় বসে কথা বলছিল। জায়গাটা আলো-আঁধারিতে ভরা। তবে আকাশে চাঁদ থাকায় হাল্কা আলো ছিল। পুজোর আয়োজনের মধ্যেই হঠাৎ দূর থেকে মোষ-চোর ‘মোষ চোর’ বলে একটা রব পেলাম। সকলেই শুনেছিলাম। কান দিইনি। গাঁয়ের দিকে এমন কতই তো হয়।
তখন রাত ৯টা হবে। পুজো শুরু হয় হয়। হঠাৎ পাঁচ-ছ’টা অপরিচিত ছেলে এসে বলল, ‘‘তোমাদের বাড়িতে কোনও ছেলে বেড়াতে এসেছে? আমরা বললাম, সে তো অনেকেই এসেছে। কী হয়েছে বল। ওরা বলল, ছেলেটা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। দেখতে চাইলে এক্ষুণি পশ্চিমপাড়ায় চল।’’
কথা শেষ করেই ওরা নিমেষে কোথায় যেন উবে গেল। আমি আর চন্দ্রা ওই অবস্থাতেই পড়িমড়ি করে ছুটলাম। রাস্তা ধরে যেতে গেলে মিনিট দ’শেক লেগে যেত। আমরা শর্টকাট করব বলে আগাছা ভরা মাঠের মধ্যে দিয়ে খালি পায়েই দৌড় দিলাম।
পশ্চিমপাড়ায় গিয়ে দেখি, অনেক লোক ভিড় করে আছে। কেউ কেউ একটা ছেলেকে মাটিতে ফেলে লাথি মারছে। আমরা ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখি, ও মা, এ তো আমাদের শুভ!
আমরা বললাম, ওকে মারছ কেন? কী করেছে ও? লোকে বলল, মোষ চুরি করে পালাচ্ছিল। আমরা বললাম, হতেই পারে না। ও একটা পড়াশোনা করা ছেলে। খামোখা মোষ চুরি করতে যাবে কেন? নিমন্ত্রণ খেতে এসেছে।
এই কথা বলতে বলতেই শুভ তখন কোনও মতে উঠে বসেছে। বলল, ‘‘মাসি বিশ্বাস কর, আমি মোষ চুরি করিনি। বটতলায় বসে ফোনে কথা বলছিলাম। এই লোকগুলো এসে হঠাৎ আমাকে ধরে মারধর করতে শুরু করল।’’
শুভর মুখে কথা শুনে রে রে করে উঠল লোকগুলো। একজন একটা ভারী টর্চ দিয়ে মাথায় মারল এক ঘা। আর একজন সজোরে লাথি কষালো পেটে। আমরা আর্তনাদ করে উঠলাম। বললাম, এমন কোরো না। রোগা-পাতলা শরীর। ছেলেটা মরে যাবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। ভিড়ের মধ্যে মহিলারাও ছিল কয়েকজন। ওদের গিয়ে বললাম, তোমাদেরও তো বাড়িতে ছেলে, ভাই আছে। এমন ভাবে মারছ কেন? ও শিক্ষিত ছেলে। অভাবের সংসার হতে পারে। কিন্তু মোষ চুরি ওর কম্মো নয়।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। ছেলেটাকে কেউ চড় মারছে। কেউ লাথি, কেউ ঘুষি। আরও একবার টর্চের বাড়ি পড়ল ওর নাকে। ফেটে গলগল করে রক্ত বেরোতে শুরু করল।
ভিড়ের মধ্যে অনেকগুলোই পরিচিত মুখ। পাশাপাশি গ্রামে থাকি। পঞ্চায়েতের সদস্য তাপস মল্লিকই সব থেকে বেশি হম্বিতম্বি করছিল। ওকে কে না চেনে। পাড়ায় বিশাল মাতব্বরি ওর। ওর ভয়ে সকলে তটস্থ। আমি বললাম, তুমি চাইলে সবাইকে থামাতে পার। কিন্তু উল্টে ও-ও শুভকে মারধর করছিল।
যেখানে ঘটনাটা ঘটছিল, সেখান থেকে থানা মেরেকেটে দু’কিলোমিটার। আমরা বলেছিলাম, দরকার মনে হলে পুলিশ ডাক। ওরাই বিচার করবে। কিন্তু বারবার কাকুতি-মিনতি করছি দেখে এ বার তাপসদের রাগ গিয়ে পড়ল আমাদের উপরেই। আমাকে আর বোনকে চুলের মুঠি ধরে ঠেলে ফেলে দিল পাশে। আবার ছেলেটাকে ঘিরে ধরে শুরু হল মার।
একটা সময় নেতিয়ে পড়ল শুভ। আমরা নাগাড়ে কেঁদে চলেছিলাম। শুভ মাটিতে পড়ে। শ্বাস-প্রশ্বাস চলছিল কিনা কে জানে। তবে ভিড় দেখলাম পাতলা হতে শুরু করেছে। এ বার তাপস বলল, ওকে ছেড়ে দিতে পারি। কিন্তু ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা দিতে হবে। আমরা বললাম, অভাবের সংসার। অত দিতে পারব না। তারপরে ঠিক হল, পরদিন ৬০ হাজার টাকা দিতে হবে। একটা সাদা কাগজে সেটা লিখিয়ে নিল বোনকে দিয়ে। তারপরে তাপস বলল, যাও, এ বার ছেলেকে নিয়ে যেতে পার। বলে দু’শো টাকা দিতে চেয়েছিল হাতে। কিন্তু আমাদের ছেলের রক্ত মাখা টাকায় হাত দেবো, ছিঃ!
তখনও আমাদের বাড়ি থেকে কেউ আসেনি। শুভকে হাসপাতালে নিয়ে যাব কী ভাবে! আমি ধরলাম ওর একটা হাত। বোন ধরল একটা পা। ভিড়ের মধ্যে থেকেই আরও দু’টো লোক হাত-পা ধরল। চ্যাংদোলা করে একটা জন্তুর মতো ঝুলিয়ে আমাদের আদরের ছেলেটাকে নিয়ে চললাম বড় রাস্তার দিকে।
সেখানে দেখি একটা ছোট গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। ড্রাইভারকে কাকুতি-মিনতি করে রাজি করালাম। সে-ই হাসপাতাল পর্যন্ত ছেড়ে দিল। টাকাও দিতে পারিনি। এত কিছুর মধ্যে ভাল মানুষটার মুখটা মনে নেই। কিন্তু ও না থাকলে ছেলেটাকে হাসপাতাল পর্যন্ত নেওয়াও মুশকিল ছিল।
রাস্তায় শুভর মুখে একটু জল দিয়েছিলাম। কিন্তু মনে হল না সেটা গলা পর্যন্ত গেল। ছেলেটার মুখ-চোখ ভেসে যাচ্ছিল রক্তে। আমাদের শাড়িও রক্তে মাখামাখি।
হাসপাতালে ডাক্তারেরা অক্সিজেন, স্যালাইন চালু করলেন। কিন্তু আধ ঘণ্টা বাদে জানিয়ে দিলেন কলকাতায় নিয়ে যেতে হবে। শুনেছিল, তাপসও নাকি ওই সময়ে হাসপাতালে এসেছিল। কিন্তু আমরা দেখিনি। ইতিমধ্যে শুভর বাবা আর বাড়ির আরও কিছু লোক এসে পড়ল। এসএসকেএম হাসপাতালে রাত ১টা নাগাদ পৌঁছেছিলাম। আধ ঘণ্টার মধ্যেই সব শেষ।
একটা ছোট ছেলেকে নৃশংস ভাবে তাপসের ওই ভয়ঙ্কর মুখটা কোনও দিন ভুলব না। যেন খুন চেপে গিয়েছিল ওদের মাথায়। আর তারপরে দু’শো টাকা হাতে গুঁজে দিতে চাইল...। ওরা কেউ মানুষ নয়, সব শয়তান। এর শেষ দেখে ছাড়ব।