জাল চিকিৎসক সামলাতে অস্ত্র পল্লি-ডাক্তারই

জেলায় জেলায় মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তার অফিস এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে স্বাস্থ্য দফতর এখন প্রচার করছে, ভুয়ো ডাক্তারদের থেকে এই পল্লি চিকিৎসকেরা সম্পূর্ণ আলাদা। পল্লি চিকিৎসকেরা অনেক বেশি নিরাপদ ও ভরসার। কারণ, এঁদের সরকারি প্রশিক্ষণ থাকবে এবং এঁরা কোন কোন চিকিৎসা করতে পারবেন বা কী কী ওষুধ দিতে পারবেন, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে।

Advertisement

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৭ ০৫:৪৫
Share:

পুলিশ-গোয়েন্দা নেমেছে। শুরু হয়েছে ধরপাকড়ও। তা সত্ত্বেও ভুয়ো চিকিৎসকের প্রাদুর্ভাব যে ক্রমবর্ধমান, তার প্রমাণ মিলছে প্রায় রোজই। এই অবস্থায় ভুয়ো ডাক্তারের বাড়বাড়ন্ত আটকাতে বিশেষ করে শহরতলি ও গ্রামাঞ্চলে এ বার প্রশিক্ষিত গ্রামীণ বা পল্লি চিকিৎসকদের হাতিয়ার করতে চাইছে রাজ্য সরকার।

Advertisement

এই গ্রামীণ চিকিৎসকেরা দীর্ঘদিন ‘হাতুড়ে ডাক্তার’ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। ২০১২ সাল থেকে পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। হাতুড়েরা গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মী বা স্বাস্থ্য-সহায়ক হিসেবে সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতি দাবি করেন, দাবি তোলেন প্রশিক্ষণেরও। এঁদের সমর্থনে এগিয়ে আসে লিভার ফাউন্ডেশন, বিশ্ব ব্যাঙ্ক এবং অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়েরা। সরকার গত নভেম্বরে তাঁদের দাবি মেনে নেয়। যে-সময়ে রাজ্য জুড়ে ভুয়ো ডাক্তার নিয়ে তোলপাড় চলছে, তখনই শুরু হয়েছে পল্লি চিকিৎসকদের সেই বহু প্রতীক্ষিত সরকারি প্রশিক্ষণ।

জেলায় জেলায় মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তার অফিস এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে স্বাস্থ্য দফতর এখন প্রচার করছে, ভুয়ো ডাক্তারদের থেকে এই পল্লি চিকিৎসকেরা সম্পূর্ণ আলাদা। পল্লি চিকিৎসকেরা অনেক বেশি নিরাপদ ও ভরসার। কারণ, এঁদের সরকারি প্রশিক্ষণ থাকবে এবং এঁরা কোন কোন চিকিৎসা করতে পারবেন বা কী কী ওষুধ দিতে পারবেন, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। ১৭ মে থেকে প্রথম দফায় রাজ্যের ২৭টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ৫০ জন করে গ্রামীণ চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ শুরু চলছে। প্রশিক্ষণের সময়সীমা ছ’মাস। অর্থাৎ ছ’মাস অন্তর ১৩৫০ জন প্রশিক্ষণ সম্পূর্ণ করে বেরোবেন।

Advertisement

স্বাস্থ্যকর্তারা জানান, প্রত্যন্ত এলাকায় চিকিৎসক পাওয়া দুষ্কর। সেখানে সাধারণ মানুষের প্রধান ভরসা এই পল্লি চিকিৎসকেরা। এঁদের পাশাপাশি জেলায় এবং গ্রামে ভুয়ো চিকিৎসকদের একাংশ চুটিয়ে প্র্যাক্টিস শুরু করেছিলেন। যে-হেতু ওই সব জায়গায় এমবিবিএস বা এমডি ডাক্তার পাওয়া কঠিন, তাই স্থানীয় মানুষ ‘ভুয়ো’ জেনেও সেই চিকিৎসকদেরই দ্বারস্থ হন। সিআইডি ভুয়ো ডাক্তার ধরার অভিযান শুরু করার পরে বেশির ভাগ জায়গায় স্থানীয় বাসিন্দারাই তাঁদের ধরিয়ে দিয়েছেন বা তাঁদের কথা পুলিশ ও মেডিক্যাল কাউন্সিলকে জানিয়েছেন। স্বাস্থ্য দফতর এখন চাইছে, জেনেশুনে ভুয়ো ডাক্তারের কাছে যাওয়ার বদলে মানুষ যেন প্রশিক্ষিত এবং স্বীকৃত পল্লি চিকিৎসকদের কাছে যান।

স্বাস্থ্যসচিব রাজেন্দ্র শুক্ল জানান, হাতুড়ে চিকিৎসকেরা আর মোটেই ‘হাতুড়ে’ নন। তাঁরা এখন প্রশিক্ষিত ও স্বীকৃত পল্লি চিকিৎসক। তাঁদের সঙ্গে জাল ডাক্তারদের এক পঙ্‌ক্তিতে বসানো যায় না। ‘‘আশা-কর্মীদের দিয়ে যেমন স্বাস্থ্যের কাজ করানো হচ্ছে, ওষুধ ও ইঞ্জেকশন দেওয়ানো হচ্ছে, সেটাই করানো হবে পল্লি চিকিৎসকদের দিয়ে। এঁদের সংখ্যা বাড়লে ভুয়ো চিকিৎসকের দাপট এমনিতেই কমবে,’’ বলেন শুক্ল।

একের পর এক ভুয়ো চিকিৎসক ধরা পড়ায় প্রকৃত ডিগ্রিধারী চিকিৎসকদের একটা বড় অংশ প্রশ্ন তুলছিলেন, জাল ডিগ্রিধারীদের ধরা হলে হাতুড়ে চিকিৎসকেরা সেই তালিকায় থাকবেন না কেন? কেন সরকার তাঁদের প্রশিক্ষণ দেবে? এঁরা যদি প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরে প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে নিজেদের চিকিৎসক বলে জাহির করে ওষুধ দেন এবং ছোটখাটো অস্ত্রোপচার করেন, তা হলে নজর রাখবে কে? নজরদারির পরিকাঠামো সরকারের আছে কি?

‘‘প্রশিক্ষণের প্রথম পর্বেই ওঁদের শেখানো হচ্ছে, ওঁরা নিজেদের চিকিৎসক বলে দাবি করবেন না। বরং সকলকে এটাই জানাবেন যে, ওঁরা গ্রামীণ স্বাস্থ্যকর্মী। ওঁরা কোনও ঠগবাজি বা ‘ম্যাজিক্যাল রেমিডি’র প্রতিশ্রুতিও দেবেন না,’’ বলছেন লিভার ফাউন্ডেশনের চিকিৎসক অভিজিৎ চৌধুরী। সেই সঙ্গে পল্লি চিকিৎসক সংযুক্ত সংগ্রাম কমিটির যুগ্মসচিব অরুণকান্তি ঘোষের আশ্বাস, তাঁদের মধ্যে কেউ নিয়ম ভাঙলে তাঁরা নিজেরাই তাঁকে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন