শহরেও ছড়িয়েছে ট্রায়াল রুম-আতঙ্ক, উদ্বিগ্ন মহিলারা

মনপসন্দ কুর্তি বাছাই করতে গিয়ে ঠিকঠাক মাপ নিয়ে খানিক সংশয়ে পড়েছিলেন মধ্যতিরিশের বহ্নি দাশগুপ্ত। দোকানের কর্মীরা তাঁকে ‘ট্রায়াল রুমে’ যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। এটুকু শুনেই মহিলা যেন প্রায় আঁতকে উঠলেন। দোকানের কর্মীদের ফিতে দিয়ে মাপ নিয়ে সাহায্য করার আর্জি জানিয়ে বহ্নিদেবী বারবার বলতে থাকেন, ‘‘রক্ষে কর! যা সব হচ্ছে ওখানে, আমি অন্তত ট্রায়াল রুমের ছায়া মাড়াব না।’’

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২১
Share:

ট্রায়াল রুমে তল্লাশি। শনিবার , শহরের এক শপিং মলে। — নিজস্ব চিত্র।

মনপসন্দ কুর্তি বাছাই করতে গিয়ে ঠিকঠাক মাপ নিয়ে খানিক সংশয়ে পড়েছিলেন মধ্যতিরিশের বহ্নি দাশগুপ্ত। দোকানের কর্মীরা তাঁকে ‘ট্রায়াল রুমে’ যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। এটুকু শুনেই মহিলা যেন প্রায় আঁতকে উঠলেন। দোকানের কর্মীদের ফিতে দিয়ে মাপ নিয়ে সাহায্য করার আর্জি জানিয়ে বহ্নিদেবী বারবার বলতে থাকেন, ‘‘রক্ষে কর! যা সব হচ্ছে ওখানে, আমি অন্তত ট্রায়াল রুমের ছায়া মাড়াব না।’’

Advertisement

গোয়ার জনপ্রিয় পর্যটনস্থল কালাঙ্গুটে একটি সর্বভারতীয় পোশাক ব্র্যান্ডের দোকানে ‘ট্রায়াল রুমে’ খোদ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানির অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশ জুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে, শুক্রবার বিকেল থেকেই। আর শনিবার দুপুরে এ শহরে প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের শপিংমলে ওই পোশাক ব্র্যান্ড ‘ফ্যাব ইন্ডিয়া’-র বিপণীতেই ‘ট্রায়াল রুম’ আতঙ্কের বহর কাকে বলে, তা ওই মহিলাকে দেখে হাতেগরম মালুম হল। দক্ষিণ কলকাতার এক নামজাদা রিটেল চেনে মেয়েকে অন্তর্বাস কিনে দিতে গিয়ে আর এক মহিলাকে দেখা গেল প্রায় নজরদার গোয়েন্দার ভঙ্গিতে। মেয়ে ট্রায়ালরুমে ঢোকার আগে মা নিজেই গম্ভীর মুখে ভিতরটা জরিপ করে দেখে এলেন।

শপিংমলগুলোয় নিরাপত্তার কারণেই সিসি টিভি-র উপস্থিতি এখন প্রায় বাধ্যতামূলক। বছর ছ’-সাত আগে থেকে জঙ্গি হানার আতঙ্কেই নাশকতা রুখতে এই প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে নাগরিকজীবনে। কয়েক বছর আগে ‘লভ সেক্স অউর ধোকা’ নামে একটি হিন্দি ছবি দেখিয়েছিল, একটি দোকানের ভিতরে দুই তরুণ-তরুণীর অন্তরঙ্গ মুহূর্ত সিসি টিভি-র ক্যামেরাবন্দি করে এমএমএসে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে নেটজগতে, এখন গোপন ক্যামেরার নজরদারি এড়ানোর নানা পরামর্শও ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু গোয়ার ঘটনার জেরে শনিবার শহরে লালবাজারের তরফে বিভিন্ন থানাকে শপিংমলগুলির পরিস্থিতি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ দিন বিকেলে সেই মতো কলকাতা পুলিশের এলাকায় বিভিন্ন থানা থেকে বস্ত্র বিপণি গুলিতে হানা দিয়েছিল।

Advertisement

সপ্তাহান্তের দুপুরে সল্টলেকের একটি শপিং মলে যতটা ভিড় প্রত্যাশা করা উচিত, তার তুলনায় শনিবার লোক কিছুটা কম। দমদম থেকে কেনাকাটা করতে এসেছিলেন আশিস ও পিয়ালী বসু। পিয়ালীর কথায়, ‘‘এতদিন গল্প শুনতাম অনেক দোকানে বা হোটেলের ঘরে এই রকম হয়। এ বার তো হাতেনাতে প্রমাণ পেলাম। তা হলে কি মেয়েদের ট্রায়াল রুমে ঢোকার আগে ইলেকট্রিশিয়ানকে পরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে?’’ চিন্তিত বন্ধুর জন্মদিনে বেড়াতে আসা রূপা, আবীরা, ঊর্মিরাও। নামী ব্র্যান্ডের দোকানেই যদি ক্রেতাদের সম্মান নিয়ে এই ভাবে ছিনিমিনি খেলা হয়, তা হলে অপেক্ষাকৃত ছোট দোকানের অনেকগুলিতে ট্রায়াল রুমের নামে কী চলছে, কে গ্যারান্টি দিতে পারে? প্রশ্ন তোলেন তাঁরা।

ওই মলেরই একাধিক ছোট দোকানের আবার অন্য রকম দাবি। ওই সব দোকানের তরফে বক্তব্য, বরং সে সব জায়গায় এই ধরনের ঘটনার আশঙ্কা কম। কারণ সেখানে সিসিটিভি কম থাকে বা থাকেই না। মলের একতলায় জামাকাপড়ের দোকান ‘ভারত ফ্যাশন’-এর কর্তৃপক্ষের কথায়, ‘‘ট্রায়াল রুমে ক্যামেরার দরকার কী? যদি ক্রেতাকে ট্রায়ালরুমে ঢোকার আগে হাতে গুনে গুনে কাপড় দেওয়া হয় এবং ট্রায়ালের পরে তিনি বেরোলে আবার গুনে ফেরত নেওয়া হয় তা হলেই তো জামাকাপড় লোপাট হওয়ার ভয় থাকে না। আসলে অনেক দোকান কর্মীর সংখ্যা না-বাড়িয়ে ক্যামেরা দিয়ে কাজ চালাতে চাইছে।’’

শহর ও শহরতলির বিভিন্ন শপিংমলে উপস্থিত আর একটি রিটেল চেন প্যান্টালুন্সের এক আধিকারিকের আশ্বাস, ট্রায়াল রুমে সিসি টিভি বসানোর প্রশ্নই নেই। বলেন, ‘‘এখানকার মহিলা কর্মীরাও তো ট্রায়াল রুমে পোশাক বদলে ইউনিফর্ম পরেন।’’

নামী ব্র্যান্ড ‘বাইলুম’-এর বিপণী রয়েছে সল্টলেকের ওই মলটিতে। সেখানে মোট চারটি সিসিটিভি বসানো। তবে তিনটি ট্রায়াল রুমের ভিতরে একটিও ক্যামেরা নেই। কর্মীরা জানালেন, সিসিটিভি এখন ‘স্টেটাস সিম্বল।’ কোনও দোকানে তা না থাকলে, সে দোকান জাতে ওঠে না। তা বলে পোশাক-বদলের ঘরে ক্যামেরা বসানোর কথা ভাবাই যায় না। এই মলেও ‘ফ্যাব ইন্ডিয়া’র একটি দোকান রয়েছে। সেখানকার কর্মীদের দাবি, দোকানে কোনও দিন কোথাও কোনও ক্যামেরা বসানো ছিল না, ফলে তা নিয়ে কোনও বিতর্ক কখনও হয়নি। ওই দোকানে শনিবার কুর্তি কিনতে আসা ছাত্রী সঞ্চারি দে অবশ্য বললেন, ‘‘কারও কথাতেই আর ভরসা রাখতে পারছি না। আমাদের মেয়েদেরই আরও সতর্ক হতে হবে। চোখ-কান খোলা রাখতে হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন