মঙ্গলবার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এর অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি।
রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করছে কেন্দ্র, বেশ কিছু দিন ধরেই এই অভিযোগ তুলছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ বার সেই অভিযোগকে হাতিয়ার করে বিজেপির বিরুদ্ধে পুরোদস্তুর রাজনৈতিক সংঘাতে যাওয়ার কৌশল নিলেন তিনি।
নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো লঙ্ঘনের অভিযোগ জানাতে মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কাছে তৃণমূলের সংসদীয় প্রতিনিধি দলকে পাঠিয়েছিলেন মমতা। কিন্তু রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া স্মারকলিপি শুধু প্রশাসনিক বিষয়ে কেন্দ্রের ‘স্বৈরাচারী হস্তক্ষেপ’-এর অভিযোগ জানিয়েই থেমে থাকল না। তাতে জোড়া হল গো-সুমারির প্রসঙ্গও। বলা হল, সুপরিকল্পিত ভাবে বাংলায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়াতে চাইছে বিজেপি। সে জন্য ওই দলের কর্মীরা জেলায় জেলায় ঘুরে গরু গুনছেন।
কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্য সরকারের সাম্প্রতিক মতান্তর পর্ব শুরু হয়েছিল ভর্তুকি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে আধার কার্ড বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নিয়ে। একশো দিনের কাজ প্রকল্পে ১৭০০ কোটি টাকা বকেয়া নিয়েও ক্ষিপ্ত ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁদের দাবি পেশ করার জন্য গত সপ্তাহেই তৃণমূল সংসদীয় দলকে নির্দেশ দিয়েছিলেন মমতা। সেই অনুযায়ী লোকসভায় তৃণমূলের নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে চিঠি পাঠিয়ে সময়ও চেয়েছিলেন। কিন্তু এরই মাঝে গত শনিবার নীতি আয়োগের একটি চিঠি পৌঁছয় নবান্নে। তাতে জানিয়ে দেওয়া হয়, ৬৬টি কেন্দ্রীয় প্রকল্প একত্রিত করা ২৮টি প্রকল্প করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০টি প্রকল্পের ৪০ শতাংশ খরচ বাধ্যতামূলক ভাবে বহন করতে হবে রাজ্যকে। এমনিতেই রাজ্যের ‘ভাঁড়ে মা ভবানী’ অবস্থা। রাজস্ব আদায় বাড়ছে না। তার ওপর কেন্দ্রের এহেন ফরমান! ফলে চিঠি হাতে পেয়েই ক্ষেপে ওঠেন মুখ্যমন্ত্রী। ‘কে তুমি ভাই পিএম’ বলে মোদীকে আক্রমণও করেন। সেই সঙ্গে সুদীপদের জানিয়ে দেন, আর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার দরকার নেই। রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ দাবি করুন।
একাধিক অনুষ্ঠানো যোগ দিতে প্রণববাবু এখন রাজ্যেই। মঙ্গলবার রাজভবনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে ১০ সদস্যের তৃণমূল প্রতিনিধি দল। পরে বেরিয়ে এসে সুদীপ বলেন, ‘‘রাজ্যের সঙ্গে কেন্দ্র যা করছে, তা বিমাতৃসুলভ বললেও কম বলা হয়। আদতে রাজনৈতিক চক্রান্ত করছে। বাংলার সঙ্গে এমন সীমাহীন বঞ্চনা অতীতে হয়নি।’’
রাষ্ট্রপতিকে তৃণমূলের প্রতিনিধিরা বলেছেন, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র করে বাংলাকে অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু করে দিতে চাইছে বিজেপি। সেই সঙ্গে কেন্দ্রে সরকারে থাকার সুযোগে অনৈতিক ভাবে রাজ্যে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে তারা। তাই রাজ্য সরকারকে একেবারে অন্ধকারে রেখে এখন কেন্দ্রীয় প্রকল্পের আওতায় গাঁ-গঞ্জে রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডার বিলিও শুরু করেছেন বিজেপি কর্মীরা। এর সঙ্গে কেন্দ্রীয় প্রকল্পে বরাদ্দ ছাঁটাই করে তার দায়ভার রাজ্যের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগ তো রয়েছেই।
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কাছে না গিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে দরবার করা কেন? পর্যবেক্ষকদের মতে, আসলে তৃণমূলও আঁচ করছে যে বরাদ্দ ছাঁটাই নিয়ে কেন্দ্রকে কিছু বলে লাভ নেই। কারণ, চতুর্দশ অর্থ কমিশন ও নীতি আয়োগের সুপারিশ অনুযায়ীই পদক্ষেপ করেছে দিল্লি। মোদী এটাই বলবেন যে, রাজ্যগুলির দাবি মেনে কেন্দ্রীয় কর বাবদ আদায় করা অর্থে রাজ্যের অংশীদারি বাড়ানো হয়েছে, যাতে তারা নিজেদের প্রয়োজনে প্রকল্প তৈরি করে বাস্তবায়ন করতে পারে।
এই অবস্থায় কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বঞ্চনার রাজনীতি করা ছাড়া উপায়ান্তর নেই তৃণমূলের। তবে তৃণমূল নেত্রী সেই আন্দোলনে একা না নেমে অন্য আঞ্চলিক দলগুলিকেও কৌশলে জড়ানোর চেষ্টা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর আঘাতের অভিযোগ তুলে পাশে পেতে চাইছেন নীতীশ কুমার-অখিলেশ যাদবদেরও। তাই রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া স্মারকলিপিতে কেবল ‘বাংলা বিপন্ন’ না-বলে লেখা হয়েছে— রাজ্যগুলির প্রশাসনিক কাজে অনৈতিক হস্তক্ষেপ করেছে কেন্দ্র।
রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া স্মারকলিপিতে কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, রাজ্যগুলির আর্থিক হিসেবনিকেশ দেখার জন্য কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি)-সহ কয়েকটি সংস্থা থাকা সত্ত্বেও কেন্দ্র এখন ‘পাবলিক ফিনান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’-এর মাধ্যমে রাজ্যের ট্রেজারিতে নজরদারি চালাতে চাইছে। এই ব্যবস্থা চালুর জন্য রাজ্যকে না-জানিয়ে রাজ্যগুলির অর্থ দফতরে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের নিয়োগ করা হচ্ছে।
নীতি আয়োগের মূল্যায়নের নাম করে কেন্দ্রের শাসক দলের পছন্দমতো প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো-কমানোর রাস্তা খোলা রাখার অভিযোগের পাশাপাশি, রাজ্যের আওতাভুক্ত বিষয়গুলিকেও নীতি আয়োগ কেন্দ্রীয় ‘কোর’ প্রকল্পে ঢুকিয়ে দিয়েছে বলে স্মারকলিপিতে জানিয়েছে তৃণমূল।