Tarun Mazumder

Tarun mazumder Death: তাঁর ছবির সুরেও বাঙালির হৃদয়পুর

তরুণ মজুমদার সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন দেশজ লোকায়ত সংস্কৃতির সঙ্গীতধারাকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে।

Advertisement

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২২ ০৬:১০
Share:

ফাইল চিত্র।

প্রথমটায় রাজিই হচ্ছিলেন না হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। বারবার বলছেন, ‘‘এ ছবির গান তো লোকসঙ্গীত নির্ভর হবে। ও দিকটায় আমি মাটো আছি! আমায় মাফ করবেন!’’ তরুণ পরিচালক নাছোড়। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, আংটি চাটুজ্যের ভাইকে যদি কেউ সুরে বাঁধতে পারে, তো সে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়!

Advertisement

তরুণ মজুমদারের সঙ্গীত-ইন্দ্রিয় কতখানি অব্যর্থ ছিল, এই কাহিনি তার প্রমাণ। ১৯৬৩-র ‘পলাতক’ একাধারে অনুপ কুমারকে নায়কের আসন দিল, হেমন্তকে সম্পূর্ণ নতুন চেহারায় হাজির করল, সাকিন দিল এক নতুন গীতিকারকে, যাঁর নাম মুকুল দত্ত। সর্বোপরি খাতায়কলমে যাত্রিকের ব্যানারে হলেও ‘পলাতক’ থেকেই তরুণ মজুমদার স্বকীয় সত্তায় তরুণ মজুমদার হলেন। এর পর থেকেই তাঁর স্বনামে পথ চলা শুরু হল। এবং তরুণ মজুমদারের ছবি মানেই এক অন্য স্বাদের গানের ডালির জন্য অপেক্ষা করতে শিখে গেল বাঙালি দর্শক।

অন্য স্বাদ, অন্য গন্ধ। তরুণ মজুমদার সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দেখিয়েছেন দেশজ লোকায়ত সংস্কৃতির সঙ্গীতধারাকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে। সেই সঙ্গে চুটিয়ে কাজে লাগিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুলপ্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গান, কীর্তন, স্বদেশি গান। মুকুন্দদাস থেকে শিবের সঙ, তরুণবাবুর ছবিতে সবার সমান আদর।

Advertisement

ষাটের দশকের জনপ্রিয় বাংলা ছবির প্রধান ঠাট, অর্থাৎ উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেনের মতো তারকা-নির্ভর ছবির ধারাটি যাত্রিকের প্রথম দিককার পাথেয় হলেও তরুণ মজুমদার নিজের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাস্তা বেছে নিয়েছিলেন। তারই অনুসারী হয়ে বদলে গিয়েছিল, বদলে যেতে বাধ্য ছিল তাঁর গানের জগত। নায়ক-নায়িকার লিপে যে প্রবল রোম্যান্টিক গানের জোয়ার তখন তুঙ্গে বিরাজ করছে, তরুণ মজুমদারের ছবিতে গানের চাহিদা, গানের দৃশ্য, গানের গড়ন তার থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। ‘চাওয়া পাওয়া’ বা ‘স্মৃতিটুকু থাক’-এর গানের ভাবনা থেকে ‘পলাতক’ কিংবা ‘বালিকা বধূ’র সঙ্গীতচিন্তা মূলগত ভাবেই ভিন্ন। অথচ তরুণ মজুমদার সেই ভিন্ন সঙ্গীতের জন্যও বাজি ধরছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের উপরে, উত্তম-সুচিত্রা ঘরানার ছবিও মূলত যাঁর কাঁধের উপরেই দাঁড়িয়ে। অর্থাৎ তরুণবাবু শুধু অনুপ কুমারদের নায়কের আসন দেবেন না, নায়কের কণ্ঠও দেবেন। উত্তমের কণ্ঠই অনুপেরও কণ্ঠ হবেন!

ছক ভেঙেও কী করে জনপ্রিয়তার রশি ধরে রাখতে হয়, সেই অঙ্কটি তরুণ মজুমদারের করায়ত্ত ছিল। সেই কারণেই বাঙালির হৃদয়পুর বারবার তাঁর ছবিতে বাঁধা পড়েছে। এঁদো পুকুর আর বাঁশবাগান আর ডুরে শাড়ি দিয়ে রোম্যান্সের মহাকাব্য রচিত হয়েছে। ‘বালিকা বধূ’ রিলিজ়ের পরে বিয়েবাড়িতে বরযাত্রী মানেই ডি এল রায়ের ‘আজি এসেছি বঁধু হে..।’ ‘পলাতক’ মুক্তির অল্প দিন পর থেকেই শহরের রাস্তায় বাঁশিওয়ালার ফুঁ...‘মন যে আমার কেমন কেমন করে!’ আবার ষাটের দশকে নায়ক-নায়িকার গানের যে চলতি ছক তরুণ অনুসরণ করেননি, আশির দশকে তরুণের ছবিতেই সেই আমেজ ফিরবে। ফিরতে হবে, কারণ হাওয়া পাল্টে গেছে। ষাটের দশকের ঘ্রাণ এ বার মন কেমনিয়া— অতএব ‘ভালবাসা ভালবাসা’। প্রবীণ হেমন্তর সুরে নবীন শিবাজী চট্টোপাধ্যায়। এই সেদিনও তো, সহস্রাব্দ পেরিয়েও বাংলা ছবির মজা ডোবায় ফের ‘আলো’র ভেলকি দেখিয়েছিলেন তরুণবাবু। তাঁর বরাবরের আশ্রয়, রবীন্দ্রসঙ্গীত সেখানেও তাঁর সহায় হয়েছিল। তরুণ মজুমদার সেই অতি বিরল পরিচালক, যাঁকে নিয়ে ‘রবীন্দ্রনাথ ও তরুণ মজুমদার’ নামে আলাদা করে অ্যালবাম হয়। তরুণ মজুমদার সেই পরিচালক যিনি এমনকি ‘দূরে কোথায় দূরে দূরে’ বা ‘চরণ ধরিতে দিও গো আমারে’র মতো অতি ভাবগম্ভীর রবীন্দ্রসঙ্গীতও সিনেমার দৌলতে আক্ষরিক অর্থে হিট করিয়ে দিতে পারতেন!

নবতিপর তনুবাবু সিনেমাপাড়া ছেড়ে অন্য পৃথিবীতে চলে গেলেন বুকের উপর গীতাঞ্জলি নিয়ে। সঙ্গীতের স্পর্শটুকু লেগে রইল অফুরান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন