উষারানিদের নাম বাদ দিয়েই হাড়োয়ার চার্জশিট

লাভপুরের মনিরুল ইসলামের পরে এ বার মিনাখাঁর উষারানি মন্ডল। তিন ভাইকে খুনের ঘটনায় চার্জশিট থেকে বাদ পড়েছিল লাভপুরের তৃণমূল বিধায়ক মনিরুলের নাম। লোকসভা নির্বাচনের দিন (১২ মে) হাড়োয়ায় সিপিএম সমর্থকদের উদ্দেশে গুলিচালনার ঘটনায় পুলিশ চার্জশিটে নাম রাখল না মিনাখাঁর তৃণমূল বিধায়ক উষারানির। বাদ গিয়েছে তাঁর স্বামী মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডলের নামও।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

হাড়োয়া শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৪ ০৩:৪৫
Share:

লাভপুরের মনিরুল ইসলামের পরে এ বার মিনাখাঁর উষারানি মন্ডল।

Advertisement

তিন ভাইকে খুনের ঘটনায় চার্জশিট থেকে বাদ পড়েছিল লাভপুরের তৃণমূল বিধায়ক মনিরুলের নাম। লোকসভা নির্বাচনের দিন (১২ মে) হাড়োয়ায় সিপিএম সমর্থকদের উদ্দেশে গুলিচালনার ঘটনায় পুলিশ চার্জশিটে নাম রাখল না মিনাখাঁর তৃণমূল বিধায়ক উষারানির। বাদ গিয়েছে তাঁর স্বামী মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডলের নামও। অথচ এফআইআর-এ তাঁদের নামই ছিল সবার আগে। সোমবারই বারাসত আদালতে উষারানিদের আগাম জামিনের আবেদন নিয়ে শুনানি রয়েছে। তার ঠিক আগেই এই চার্জশিট পেশ করল পুলিশ।

হাড়োয়ার ঘটনার পরে উষারানি-সহ ৩১ জনের বিরুদ্ধে খুনের চেষ্টা, অস্ত্র-সহ জমায়েত, ভোটদানে বাধা দেওয়া, মারধর-সহ বেশ কিছু অভিযোগ দায়ের হয়েছিল। কিন্তু হাড়োয়ার আইসি রবীন্দ্রনাথ ভৌমিক শনিবার বসিরহাট আদালতে যে চার্জশিট জমা দিয়েছেন, তাতে বিধায়ক ও তাঁর স্বামীর নাম নেই। তাঁদের নাবালক ছেলে নীলোৎপলের নাম অবশ্য রয়েছে। এফআইআর-এও নীলোৎপলের নাম ছিল। কিন্তু উষারানি ও মৃত্যুঞ্জয়ের নাম নেই কেন? আইসি-র মোবাইল বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করা যায়নি তাঁর সঙ্গে। তবে জেলা পুলিশের একটি সূত্র বলেন, ঘটনার সঙ্গে ওই দু’জনের যোগাযোগের কোনও প্রমাণ মেলেনি। মৃত্যুঞ্জয়বাবু টেলিফোনে বলেন, “এ বার প্রমাণিত হল, আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগটা কতটা ভিত্তিহীন ছিল।”

Advertisement

উষারানিদের আইনজীবী বিকাশ ঘোষ জানাচ্ছেন, তদন্তের সময় দু’জনকে একাধিক বার জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণও খতিয়ে দেখা হয়েছে। পুলিশি তদন্তে দাবি, ১২ মে অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতেই ছিলেন উষারানি। তাঁর শুশ্রূষায় ব্যস্ত ছিলেন মৃত্যুঞ্জয়বাবু। পরে গোলমালের খবর পেয়ে মৃত্যুঞ্জয় ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। তখন বেলা প্রায় ১০টা। তত ক্ষণে গোলমাল প্রায় মিটেই গিয়েছে। পুরো ঘটনা তদন্ত করে দেখার পরেই চার্জশিট থেকে বাদ গিয়েছে উষারানিদের নাম।

প্রশ্ন উঠেছে, যাঁদের পলাতক বলে খাতায়-কলমে দেখানো হচ্ছিল দু’মাস ধরে, তাঁদের সঙ্গে একাধিক বার পুলিশ কথা বলল কী করে? পুলিশ বা উষারানিদের আইনজীবীর তরফে অবশ্য এর কোনও ব্যাখ্যা মেলেনি। মৃত্যুঞ্জয়ের বক্তব্য, “আমরা আগাগোড়াই বাড়িতে ছিলাম, কোথাও পালিয়ে যাইনি। তদন্তের স্বার্থে যত বার ডেকেছে পুলিশ, হাজির থেকে সাহায্য করেছি।” বিকাশবাবু জানান, ৭ জুন শেষ বারের মতো উষারানি ও তাঁর স্বামীর সঙ্গে কথা বলেছে পুলিশ।

এই জাতীয় ঘটনা অবশ্য সাম্প্রতিক কালে নতুন নয়। ২০১০ সালের ৩ জুন বীরভূমের লাভপুরে স্থানীয় নেতা মনিরুল ইসলামের বাড়িতে সিপিএম সমর্থক তিন ভাইকে পিটিয়ে মারার অভিযোগ ওঠে। এফআইআর-এ নাম ছিল মনিরুলের। পুলিশ গ্রেফতারও করেছিল মনিরুলকে। কিন্তু নিহতদের পরিবার যে জবানবন্দি দেয়, তাতে মনিরুলের নাম ছিল না। তবে পরবর্তী কালে তাঁরা অভিযোগ করেন, রাজনৈতিক চাপের মুখেই তাঁরা মনিরুলের নাম বলতে পারেননি। মনিরুল নিজে একটি জনসভায় তিন ভাইকে খুন করার কথা স্বীকারও করেন। তার পরেও গত ১৭ জুন পুলিশ এই মামলার চার্জশিটে মনিরুল-সহ ২২ জনের নাম রাখেনি।

বীরভূমের তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল-সহ কয়েক জনের বিরুদ্ধে পাড়ুই মামলায় এফআইআর হলেও গ্রেফতার তো দূর, অনুব্রতকে এক বারও জিজ্ঞাসাবাদ করেনি পুলিশ। হাইকোর্টে সেই মামলা এখনও চলছে।

গত ৭ মে লোকসভা ভোটের দিন বাঁকুড়ার সোনামুখীর বিধায়ক দীপালি সাহার বিরুদ্ধে বুথে ঢুকে নির্বাচন কর্মীদের উপরে হামলা করার অভিযোগ ওঠে। এফআইআর দায়ের হলেও পুলিশ তাঁকে ধরেনি। ঘটনার দেড় মাস পরে তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। তাঁর আইনজীবীর দাবি, দেড় মাস অসুস্থ অবস্থায় বাড়িতেই ছিলেন দীপালি। অথচ পুলিশ তাঁকে খুঁজে পায়নি।

সম্প্রতি নদিয়ার চৌমুহা গ্রামে বিরোধীদের বাড়িতে ‘ছেলে ঢুকিয়ে রেপ করিয়ে দেওয়ার’ হুমকি দিয়েছেন তৃণমূল সাংসদ তাপস পাল। বিরোধীদের খুন করার ডাক দিয়েছেন। নিজের কাছে অস্ত্র রাখার কথা কবুল করেছেন। তার পরেও চিঠি লিখে ক্ষমা চেয়েই তাপস পার পেয়েছেন।

সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু রবিবার অভিযোগ করেন, পুলিশের একাংশকে দলদাসে পরিণত করা হয়েছে। এই সব ঘটনা তারই পরিণাম। রায়দিঘিতে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেন, “বাড়িতে আগুন লাগানো, পুলিশের গাড়িতে বোমা মারার হুমকি, তিনটি লোককে পায়ের তলা দিয়ে মেরে দিয়েছি এ সব যারা বলছে, তাদের পুলিশ কিছু করতে পারছে না। হাইকোর্ট বলছে, কিছু করুন। তাতেও কিছু হচ্ছে না।” বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রর বক্তব্য, “পুলিশকে দোষ দিয়ে কী হবে? রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যদি সাফাই দেন, অপরাধীদের আড়াল করে তাদের সার্টিফিকেট দেন, তা হলে কী হবে? মন্ত্রী যদি এই বলেন, তবে সান্ত্রীরা কী করবে?”

বিরোধীদের এই অভিযোগ যথারীতি মানেনি শাসক দল। জেলা তৃণমূল পর্যবেক্ষক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, “সিপিএমের প্ররোচনায় নির্বাচন কমিশন এক গৃহবধূকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়েছিল। তদন্তে প্রমাণ হল, গৃহবধূ ও তাঁর স্বামী কোনও ভাবেই অপরাধে জড়িত নন।” আইনজীবী বিকাশবাবুর বক্তব্য, “রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়েই যদি চার্জশিট তৈরি হবে, তা হলে বিধায়কের ছেলের নাম কী করে রইল সেখানে?” সিপিএম অবশ্য মনে করছে, নাবালক হওয়ায় নীলোৎপল সহজেই জামিন পেয়ে যাবে। স্রেফ ভাঁওতা দিতেই তার নাম রাখা হয়েছে।

হাড়োয়ার মানুষের আশঙ্কা, উষারানিদের নাম চার্জশিট থেকে বাদ পড়ায় ফের অশান্ত হতে পারে এলাকা। রাজ্যে শেষ দফা ভোটের দিন ব্রাহ্মণচক গ্রামে সশস্ত্র হামলার স্মৃতি এখনও টাটকা। ওই ঘটনায় উষারানি, তাঁর স্বামী ও ছেলে-সহ, শাসক ও বিরোধী উভয় পক্ষের ৩১ জনের নামে এফআইআর দায়ের হয়। তদন্তে নেমে পুলিশ গ্রেফতার করে সিপিএম নেতা দীনবন্ধু মণ্ডল-সহ ১৩ জনকে। সকলেই পরে জামিনে ছাড়া পান।

দীনবন্ধুবাবুর দাবি, “আমি দেখেছি, উষারানি ও মৃত্যুঞ্জয়ের নির্দেশেই বোমা-গুলি নিয়ে হামলা চালাচ্ছে তৃণমূলের ছেলেরা। ওদের কেউ ধরল না। উল্টে আমাকে গ্রেফতার করা হল।” মৃত্যুঞ্জয়বাবুর পাল্টা দাবি, দীনবন্ধুদের অত্যাচার ঠেকাতে গিয়েই তিনি চক্রান্তের শিকার হয়েছিলেন। তাঁর নামে মিথ্যা অভিযোগ আনা হয়েছিল। ২০০৯ সালেও মৃত্যুঞ্জয়বাবুর বিরুদ্ধে জোড়া খুনের অভিযোগ উঠেছিল। মাস কয়েক আগে ওই ঘটনায় যে চার্জশিট পেশ করে সিআইডি। সেখান থেকেও বাদ পড়ে প্রভাবশালী এই তৃণমূল নেতার নাম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন