বাবা না মা, টানাটানিতে কোর্টেই কান্না ভাইবোনের

হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছে বছর দশেকের একটি মেয়ে। আর এজলাসের বারান্দায় কাঠের বেঞ্চে বসে থাকা এক যুবকের ফুলহাতা নীল টি-শার্ট খিমচে ধরে সে বারে বারেই চেঁচিয়ে বলছে, ‘‘আমি তোমাকেও চাই। মাকেও চাই।’’

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৬ ১০:১৭
Share:

• হাপুস নয়নে কেঁদে চলেছে বছর দশেকের একটি মেয়ে। আর এজলাসের বারান্দায় কাঠের বেঞ্চে বসে থাকা এক যুবকের ফুলহাতা নীল টি-শার্ট খিমচে ধরে সে বারে বারেই চেঁচিয়ে বলছে, ‘‘আমি তোমাকেও চাই। মাকেও চাই।’’

Advertisement

• যুবকটির কোলে বছর পাঁচেকের একটি ছেলে। সে ওই যুবকের গলা জড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, ‘‘আমি তোমার কাছেই থাকব। মায়ের কাছে থাকব না।’’

• যুবকের থেকে কিছুটা দূরে কাঠের বেঞ্চে লাল শাড়ি পরে মাথা নিচু করে বসে আছেন এক মহিলা।

Advertisement

মঙ্গলবার কলকাতা হাইকোর্টের তেতলায় ১৯ নম্বর আদালতের বাইরে ওই দুই ভাইবোনের কান্না দেখে চোখ মুছতে দেখা গেল পুলিশকর্মী, আইনজীবী, কোর্টের আর্দালি-সহ অনেককেই। দশ বছরের দিদি চায় মা-বাবা দু’জনকেই। পাঁচ বছরের ভাই মাকে চায় না, বাবার কাছে থাকতে চায়। তাদের চাওয়া কী ভাবে কতটা মূল্য পাবে, এ দিন তার ফয়সালা হয়নি। দিনশেষে ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দেয়, পরবর্তী নির্দেশ না-দেওয়া পর্যন্ত দুই ভাইবোনকে রাখতে হবে তাদের মায়ের কাছেই।

ঘটনাটা কী?

স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া, তবে মামলাটি ঠিক বিবাহ-বিচ্ছেদের নয়। ছেলেমেয়ে কার কাছে থাকবে, বিবাদ তা নিয়েই। হাইকোর্ট সূত্রের খবর, হাওড়ার এক তরুণীর সঙ্গে শিলিগুড়ির বাসিন্দা ওই যুবকের টেলিফোনে আলাপ হয়েছিল। ফোনালাপ পর্ব শেষে ২০০৫ সালে তাঁরা বিয়ে করেন। যুবক শিলিগুড়িতে ব্যবসা করেন বলে তরুণীকে জানিয়েছিলেন। বিয়ের পরে ওই দম্পতি শিলিগুড়িতেই থাকতেন। তাঁদের একটি মেয়ে, একটি ছেলেও হয়। ওই মহিলা আদালতে জানান, ২০১২ সালে তিনি জানতে পারেন, তাঁর স্বামী যে-ব্যবসা করেন, সেটা আসলে বন্ধুত্ব পাতিয়ে দেওয়ার ব্যবসা। সেই ব্যবসাকে কেন্দ্র করে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্য শুরু হয়। ওই বছরই মেয়ে আর ছেলেকে নিয়ে মহিলা চলে আসেন হাওড়ায় বাপের বাড়িতে। আদালতে মহিলার অভিযোগ, কয়েক মাস পরে স্বামী এসে প্রায় জোর করেই মেয়েকে নিয়ে শিলিগুড়ি ফিরে যান। ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়িতে থেকে যান মহিলা।

ছেলেমেয়েকে নিজের কাছে রাখতে চেয়ে ওই বছরই শিলিগুড়ি আদালতে পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করেন স্বামী ও স্ত্রী। গত বছর সেখানকার আদালত রায় দেয়, মেয়ে বাবার কাছে থাকবে। ছেলে থাকবে মায়ের কাছে। নিম্ন আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে স্বামী এবং স্ত্রী মাসখানেক আগে হাইকোর্টে আলাদা আলাদা আপিল মামলা করেন। গত ১৭ মে বিচারপতি নিশীথা মাত্রে ও বিচারপতি রাকেশ তিওয়ারির ডিভিশন বেঞ্চে তার শুনানি ছিল। ওই দিন বিচারপতি মাত্রে দম্পতির মেয়ে ও ছেলেকে নিজের চেম্বারে নিয়ে গিয়ে জানতে চান, তারা কোথায় এবং কার কাছে থাকতে চায়।

আদালত খবর, মেয়েটি বলে, সে বাবা ও মায়ের সঙ্গে থাকবে। কিন্তু ছেলেটি বলে, সে মায়ের কাছে যেতে চায় না, থাকবে বাবার কাছে। বিচারপতি মাত্রে ওই যুবককে নির্দেশ দেন, তিনি যেন শিলিগুড়ির ব্যবসা গুটিয়ে কলকাতায় এসে অন্য কোনও ব্যবসা করেন এবং ছেলেমেয়েকে কলকাতার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। যুবক এক বছর সময় চান। কিন্তু তাতে বিচারপতি মাত্রে রাজি হননি। ডিভিশন বেঞ্চ সে-দিন নির্দেশ দেয়, গরমের ছুটির এক মাস ছেলে ও মেয়ে থাকবে মায়ের কাছে।

এ দিন ফের মামলাটি ওঠে শুনানির জন্য। মেয়েটি আদালতে ঢুকেই বাবাকে দেখে কাঁদতে শুরু করে। ছেলেও বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। তা দেখে ডিভিশন বেঞ্চ আদালতের অফিসারদের নির্দেশ দেয়, দম্পতি এবং দুই শিশুকে কিছু ক্ষণের জন্য আদালতের বাইরে নিয়ে যাওয়া হোক। বাইরে বেরোতেই কান্না বেড়ে যায় দুই শিশুর। তরুণী এক সময় স্বামীর উদ্দেশে বলেন, ‘‘আমি তোমায় ডিভোর্স দেব না।’’ স্বামী সে-কথা শুনে মেয়েকে জড়িয়ে বলেন, ‘‘কোনও চিন্তা করিস না। আমি সুপ্রিম কোর্টে যাব।’’

আইনজীবীরা জানান, ডিভিশন বেঞ্চ এ দিন চূড়ান্ত রায় দেয়নি। বলেছে, পরবর্তী নির্দেশের জন্য স্বামী ও স্ত্রী দু’জনকেই অপেক্ষা করতে হবে। তত দিন দুই সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে পারবেন মা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন