State News

ফাঁকা নেই ‘সূচ্যগ্র মেদিনী’ও, মোদীর সভার আগে মেদিনীপুর যেন যুদ্ধক্ষেত্র

নরেন্দ্র মোদীর বিমান কলাইকুন্ডা বায়ুসেনা ঘাঁটিতে নামবে সোমবার। সেখান থেকে কপ্টারে মোদী পৌঁছবেন মেদিনীপুর পুলিশ গ্রাউন্ডে। পুলিশ গ্রাউন্ড থেকে আড়াই কিলোমিটার সড়কপথ পেরিয়ে মোদী ঢুকবেন কলেজ গ্রাউন্ডে। বিজেপি সূত্রের খবর এ রকমই।

Advertisement

ঈশানদেব চট্টোপাধ্যায়

মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৮ ০১:৪৯
Share:

দেশের প্রধানমন্ত্রী আসছেন জেলা শহরে, আর তাই গোটা মেদিনীপুর সেজেছে বড় বড় ব্যানার, হোর্ডিং, স্ট্যান্ডি আর তোরণে। নিজস্ব চিত্র।

জাতীয় সড়ক-৬ ধরে গাড়িটা হু-হু করে ছুটছিল মেদিনীপুরের দিকে। আর কত দূর? মাইলস্টোন খেয়াল করা হয়নি। জিপিএস অন করলেই হয়। কিন্তু অন করতে গিয়েও থমকে যেতে হল। কারণ রাস্তার দু’ধারই ততক্ষণে জানান দিতে শুরু করেছে, ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ খুব কাছেই।

Advertisement

‘যুদ্ধক্ষেত্র’ই বটে। গোটা মেদিনীপুর শহর জুড়ে ‘যুদ্ধের’ প্রস্তুতি। দেশের প্রধানমন্ত্রী আসছেন জেলা শহরটায়। ‘কৃষক কল্যাণ সমাবেশে’ ভাষণ দেবেন তিনি। কিন্তু রাজ্যের শাসক দল ভাল ভাবেই জানে, শুধু চাষিদের সঙ্গে কথা বলতে নরেন্দ্র মোদী বাংলায় আসছেন না। মূল লক্ষ্য তৃণমূলের বিরুদ্ধে সুরটা এক ধাক্কায় চড়িয়ে দিয়ে পরবর্তী ভোটযুদ্ধের বাদ্যিটা কার্যত বাজিয়ে যাওয়া। তাই তৃণমূলও বুঝিয়ে দিতে চায়— মেদিনীপুরেই হোক বা বাংলার অন্য কোনও প্রান্তে, বিনা যুদ্ধে ছাড়া হবে না ‘সূচ্যগ্র মেদিনী’ও।

মেদিনীপুর শহরে ঢোকার সাত-আট কিলোমিটার আগে থেকেই রাস্তায় বড় বড় ব্যানার, হোর্ডিং, স্ট্যান্ডি, তোরণ। একই অবস্থা খড়্গপুর শহরেরও। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সবচেয়ে বড় দুই শহর এবং শহরদুটোয় পৌঁছনোর প্রায় সব রাস্তা হোর্ডিঙে-ব্যানারে ছয়লাপ।

Advertisement

দেখুন ভিডিয়ো

২১ জুলাই তৃণমূলের শহিদ স্মরণ সমাবেশ কলকাতায়। দলের রাজ্য স্তরের নেতারা বিভিন্ন জেলায় প্রস্তুতি সভা করে বেড়াচ্ছেন বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে। রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সি তেমনই এক সভায় গিয়েছিলেন মেদিনীপুরে। সেই সভা থেকেই তৃণমূল কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বার্তা দেন, নরেন্দ্র মোদী মেদিনীপুরে যখন আসবেন, তখন পথের দু’ধার যেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিতে মোড়া থাকে। জেলা সভাপতি অজিত মাইতির আহ্বানও ছিল একই রকম। নেতৃত্বের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন পশ্চিম মেদিনীপুরের তৃণমূল কর্মীরা। রাস্তার দু’ধার জুড়ে ‘বাংলার উন্নয়ন’ সংক্রান্ত ফ্লেক্স তো শোভা পাচ্ছেই। শোভা পাচ্ছে ২১ জুলাই ধর্মতলা যাওয়ার ডাক দিয়ে তৈরি করা ব্যানারও। সবেতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি। রয়েছেন অভিষেকও।

পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সবচেয়ে বড় শহরদুটোয় পৌঁছনোর প্রায় সব রাস্তা হোর্ডিঙে-ব্যানারে ছয়লাপ।

তৃণমূলের এই ফ্লেক্স-যুদ্ধ নতুন নয়। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ যখন বীরভূমে এসেছিলেন, তখন তাঁর যাত্রাপথের দু’ধারও মুড়ে দেওয়া হয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবিতে। এ বার মোদীর জন্যও একই ‘দাওয়াই’ রাজ্যের শাসক দলের। অর্থাৎ এ রাজ্যের কোনও অংশে বিজেপির কোনও হেভিওয়েট পা রাখলেই ব্যারাকিং-এর মতো পরিস্থিতি তৈরি করা হবে— তৃণমূল সম্ভবত এই বার্তাই দিতে চাইছে।

আরও পড়ুন: আসছেন মোদী, কৃষক আজ উপলক্ষ

বিজেপি এর মোকাবিলা কী ভাবে করবে? বিজেপি নেতারা মুখে বলছেন, মোকাবিলা করার প্রয়োজনই নেই। কেন প্রয়োজন নেই? রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র সায়ন্তন বসু মেদিনীপুরে বসেই বললেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর যাত্রাপথের দু’ধারে যদি পিসি-ভাইপো হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকতে চান, তাতে আমাদের আপত্তির কী আছে? আমরা তো ইতিবাচক ভাবেই নিচ্ছি। মোদীজিকে তাঁরা স্বাগত জানাচ্ছেন— এ ভাবেই দেখছি বিষয়টাকে।’’ আর প্রধানমন্ত্রী মোদী সোমবার যে মাঠে সভা করবেন, সেই কলেজ গ্রাউন্ডে দাঁড়িয়ে রাজ্য বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাজু বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন, ‘‘আমাদের লড়াইটা ওই ছবি দেখানোর লড়াই নয়। আমাদের লড়াইটা মাঠে-ময়দানে। প্রধানমন্ত্রীর সভার সময় দেখতে পাবেন, কী ভাবে গোটা মেদিনীপুর শহরটা বিজেপি-ময় হয়ে গিয়েছে।’’

মুখে এ কথা বললেও, কার্যক্ষেত্রে বিজেপির ভূমিকা কিন্তু অন্য রকম। তৃণমূল যে পরিমাণ ব্যানার-ফেস্টুন-পতাকা ঝুলিয়েছে মেদিনীপুর শহরে, বিজেপি-ও প্রায় তার সমানই। সোমবার সকাল থেকে শহরের বর্ণালীতে গেরুয়া রঙের ছটা আরও বাড়বে বলে বিজেপির স্থানীয় কর্মীদের দাবি।

রাস্তার দু’ধার জুড়ে ‘বাংলার উন্নয়ন’ সংক্রান্ত ফ্লেক্স । সঙ্গে ২১ জুলাই ধর্মতলা যাওয়ার ডাক দিয়ে তৈরি করা ব্যানারও।

নরেন্দ্র মোদীর বিমান কলাইকুন্ডা বায়ুসেনা ঘাঁটিতে নামবে সোমবার। সেখান থেকে কপ্টারে মোদী পৌঁছবেন মেদিনীপুর পুলিশ গ্রাউন্ডে। পুলিশ গ্রাউন্ড থেকে আড়াই কিলোমিটার সড়কপথ পেরিয়ে মোদী ঢুকবেন কলেজ গ্রাউন্ডে। বিজেপি সূত্রের খবর এ রকমই। তবে প্রধানমন্ত্রীর যাত্রাপথের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এসপিজি-ই নেবে। তাই যাত্রাপথ শেষ মুহূর্তে বদলে যেতে পারে বলেও জল্পনা রয়েছে।

যে পথেই মোদী যান, মমতা আর অভিষেকের বিপুল সংখ্যক ছবি তাঁকে দেখতেই হবে— বন্দোবস্ত সে রকমই করেছে তৃণমূল। বিজেপি-ও এমনই আয়োজন সাজিয়েছে শহর জুড়ে, যাতে মোদী বুঝতে পারেন যে, তৃণমূলের চোখে চোখ রেখে কথা বলার চেষ্টাই করেছে তাঁর দল।

আরও পড়ুন: মোদীর সভায় ক্ষোভের আঁচ

দু’দলের এই সাংঘাতিক তৎপরতার ফল কী হয়েছে? এর ফল হল, মেদিনীপুরবাসীর অপার বিস্ময়! কোর্ট মোড় হোক বা কেরানিটোলা চক, কলেজ গ্রাউন্ডে পৌঁছনোর রাস্তা হোক বা স্টেশন রোড— সর্বত্রই সাধারণ মানুষের চোখে বিস্ময়। মফস্সল শহরটার ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে এমন গাঢ় রাজনৈতিক রং আগে কখনও দেখেননি এলাকার মানুষ। তবে লোকজন কিয়ৎ পুলকিতও বটে। কারণ গোটা রাজ্যের ফোকাস এখন যে ভাবে মেদিনীপুরের উপরে, তেমনটা আগে কখনও দেখেননি এ শহরের বাসিন্দারা।

তৃণমূল অবশ্য এখন বলছে, বিজেপির সঙ্গে টক্করের প্রশ্নই নেই, বিজেপি-কে অত গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা তৃণমূলের সভাপতি অজিত মাইতিকে আজকাল শহরে খুব বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি শহিদ স্মরণ সমাবেশের প্রস্তুতিতে ব্লকে ব্লকে ঘুরছেন। অজিত মাইতি সদর্পে বললেন, ‘‘নরেন্দ্র মোদী কোনও ফ্যাক্টর নন। নরেন্দ্র মোদীর জন্য আমরা ফ্লেক্স-ব্যানার লাগিয়েছি, এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই।’’ কিন্তু মোদীর যাত্রাপথ মমতার ছবিতে মুড়ে দেওয়ার ডাক যাঁরা দিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অজিত নিজেও তো অন্যতম। প্রশ্নটা যেন কানেই গেল না তাঁর। বেশ সপ্রতিভ ভঙ্গিতেই বরং বললেন, ‘‘শহিদ স্মরণের জন্য প্রত্যেক বছরই কলকাতায় আমাদের সমাবেশ হয়। প্রত্যেক বছরই আমরা সভার আগে এ ভাবেই ফ্লেক্স-ব্যানার লাগাই। এ বার শহিদ স্মরণের ২৫ বছর। তাই তোড়জোড় অন্যান্য বারের চেয়ে কিছুটা বেশি। এর সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর কোনও সম্পর্ক নেই।’’

নেতারা যা-ই বলুন, সাধারণ শহরবাসী কিন্তু বেশ বুঝতে পারছেন, বেনজির পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এলাকায়। চেনা শহর অচেনা হয়ে উঠেছে। তার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার জন্য মেদিনীপুর জুড়ে দাপাদাপি শুরু হয়েছে, পুলিশ, কেন্দ্রীয় বাহিনী, এসপিজি এবং বিভিন্ন কেন্দ্রীয় এজেন্সির।

সাজ সাজ রব যেন সর্বত্র। সাজ সাজ রব শহরের বেশ কিছুটা দূর দিয়ে যাওয়া জাতীয় সড়কেও। খুব প্রতীকী যেন ছবিটা। তৃণমূল আর বিজেপির লড়াইটা আর শুধু বাংলায় সীমাবদ্ধ নেই। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে বিরোধী শিবিরে ঐক্য আনতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে উদ্যোগী, তাতে জাতীয় রাজনীতিতেও তৃণমূল এখন বিজেপির অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জার। ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক যেন ২০১৯-এর সেই রণক্ষেত্রে গিয়েই মিশছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন