অতিশয়, অনর্গল আবেগ আমাদেরও রোমান করে তুলতে পারে!

রোমান মব— খুব মনে পড়ছে তাঁদের কথা। শেক্সপিয়রের নাটকে বেশ একটু নেতির আলোতেই আলোকিত এই রোমান জনতা। আবেগের আধিক্যই বলা হোক বা হুজুগের বাড়াবাড়ি, আচরণে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা নাকি অভ্যাসগত ছিল রোমান জনতার।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৬ ০১:৩০
Share:

প্রতীকী ছবি।

রোমান মব— খুব মনে পড়ছে তাঁদের কথা। শেক্সপিয়রের নাটকে বেশ একটু নেতির আলোতেই আলোকিত এই রোমান জনতা। আবেগের আধিক্যই বলা হোক বা হুজুগের বাড়াবাড়ি, আচরণে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলা নাকি অভ্যাসগত ছিল রোমান জনতার। প্রবল প্রতাপান্বিত এবং সম্মাননীয় শাসক জুলিয়াস সিজারের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হতে সময় লাগেনি এই রোমান জনতার। আবার সেই ‘ঘৃণিত’ সিজারের হত্যার অল্প ক্ষণের মধ্যেই খুনের মূল চক্রী ‘মাননীয়’ ব্রুটাসকে ঘোষিত শত্রু মনে করতেও সমস্যা হয়নি।

Advertisement

এই ভারসাম্যহীনতাই নেতির আলো ফেলেছিল আবেগে ভরপুর একটা জনকল্লোলের উপর। রোমান জনতার সেই ভারসাম্যহীনতা নিজেদের মধ্যেই যেন টের পাচ্ছি খানিকটা।

ক’দিন আগে হারিয়েছি আবেশ নামে এক কিশোরকে। তার মৃত্যুর কারণ নিয়ে বিস্তর কাটাছেঁড়া, বাদ-বিসম্বাদ, যুক্তি-তর্ক। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় বইতে দেখলাম। অনেকেই নিজেদের শৈশব, বাল্য, কৈশোর টেনে আনলেন। অভিভাবক কেমন কড়া হাতে রাশটা ধরে থাকতেন, স্কুলে শিক্ষক কেমন ঠ্যাঙানি-পেটানির উপর রাখতেন, তা সত্ত্বেও কী ভাবে শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান-সমীহের বিন্দুমাত্র ঘাটতি হত না— সে সবের নানা বিবরণে ভরে উঠল সোশ্যাল মিডিয়া।

Advertisement

কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্তে বা উপসংহারে পৌঁছতে যখন আবেগটাই মূল মাধ্যম হয়ে ওঠে, তখন এই রকমই হয়। যুক্তিগুলো হারিয়ে যায়। দৃষ্টিটা যথেষ্ট স্বচ্ছ থাকে না। দৃষ্টির উপর থেকে আবেগের পর্দাটা তখন সরে, যখন ঠিক বিপরীত আবেগ উস্কে দেওয়ার মতো একটা ঘটনা আবার ঘটে।

দমদমের এক স্কুলে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী রোল নম্বরটা লিখতে ভুল করেছিল। শিক্ষিকা এমন ঠ্যাঙানি-পেটানি দিলেন, রক্তাক্ত হল ছাত্রী, সংজ্ঞা হারাল। এ বার আমরা বুঝলাম, শাসনটাও অতিরিক্ত ভাল নয়। শিক্ষকের শাসনটাও অযৌক্তিক এবং ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে, উপলব্ধি হল। দমদমের ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, শাসনের বাড়াবাড়ি অনেক ক্ষেত্রেই বেআইনি হয়ে ওঠে। শিক্ষকের শাসন পড়ুয়ার উপর শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের স্তরে পৌঁছে যাক, ভারতীয় আইন তা কখনও-ই সমর্থন করে না।

আবার ঝড় উঠেছে। ওই শিক্ষিকার বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় উঠেছে। স্কুলে পড়ুয়াকে শাসন করা হবে কেন? তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা শুরু হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আচরণে কত রকমের বেড়ি পরানো দরকার, সে সব নিদানও দেওয়া হচ্ছে।

অর্থাৎ, এ বারও সেই আবেগের বাড়াবাড়ি। দমদমের ওই শিক্ষিকা ঘোর অন্যায় করেছেন সংশয় নেই। চরম অসংবেদনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন সংশয় নেই। কিন্তু এর নিবারণে যে সব নিদান দিচ্ছি আমরা, সেও অতি চরমপন্থী।

ভারসাম্যটা এখানেই জরুরি। বোঝা দরকার, অতিশয়তা কোনও ক্ষেত্রেই কাম্য নয়। শাসনেও নয়, শাসনহীনতাতেও নয়। অতিশয় শাসন যেমন বিপদ ডেকে আনে, অবাধ প্রশ্রয়ও তেমনই।

অবাধ, অনর্গল আবেগও কিন্তু বিপর্যয়ের বাহক। ভারসাম্যটা সেখানেও জরুরি। না হলে আয়নাতে নিজেদের মুখটাও রোমান জনতার মতোই দেখাবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন