Bengali News

সোমেন-অধীর ঐক্যের ছবি, কানায় কানায় জমায়েত, মমতাকে তীব্র কটাক্ষ কংগ্রেসের

প্রদেশ সভাপতি পদে রদবদলের পরে দলের অন্দরে পরিস্থিতি যে ভাবে টালমাটাল হয়েছিল, তা কাটিয়ে উঠে মোটের উপর একটা ঐক্যের ছবি তুলে ধরাই অঘোষিত ভাবে অন্যতম লক্ষ্য ছিল। সে লক্ষ্যে সোমেন মিত্র সফল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৮ ২১:৪৪
Share:

ধর্মতলার মঞ্চে বুধবার ঐক্যের ছবি তুলে ধরলেন সোমেন-অধীররা। নিজস্ব চিত্র।

ছিল ‘ঘরে-বাইরে সঙ্কট’। বাইরের সঙ্কটটাকে রুখে দেওয়া যাচ্ছে— আভাস মিলেছে সদ্য। তাতেই নিজের ঘরে রাতারাতি চাঙ্গা পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস। ধর্মতলায় বুধবার কংগ্রেসের যে জমায়েত দেখা গেল, তাতে উচ্ছ্বসিত বিধান ভবন। উচ্ছ্বাসের সমাবেশ থেকে সোমেন-অধীরদের বার্তা— এ বার ঘরের মাঠেও বোঝাপড়াটা সেরে ফেলার সময় হয়েছে। রানি রাসমণি অ্যাভিনিউতে দাঁড়িয়ে নবান্নের কর্ত্রীকে বহরমপুরের সাংসদের চ্যালেঞ্জ, ‘‘আগামী লোকসভা নির্বাচনে আপনার কী হাল হয়, সে আমরা দেখিয়ে দেব।’’

Advertisement

রানি রাসমণি অ্যাভিনিউতে ১২ ডিসেম্বর যে জনসভা হবে, তা প্রদেশ কংগ্রেস অনেক আগেই ঘোষণা করেছিল। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়ে কংগ্রেসের জয়ের প্রেক্ষিতে এই সমাবেশ ছিল, তা নয়। বরং প্রদেশ সভাপতি পদে রদবদলের পরে দলের অন্দরে পরিস্থিতি যে ভাবে টালমাটাল হয়েছিল, তা কাটিয়ে উঠে মোটের উপর একটা ঐক্যের ছবি তুলে ধরাই অঘোষিত ভাবে অন্যতম লক্ষ্য ছিল। সে লক্ষ্যে সোমেন মিত্র সফল। কংগ্রেসের ডাকে শেষ কবে ধর্মতলার এই সভাস্থল এমন কানায় কানায় ভরেছে, তা অনেকেই মনে করতে পারছেন না। সোমেন মিত্র, অধীর চৌধুরী, প্রদীপ ভট্টাচার্য, আবদুল মান্নান, দীপা দাশমুন্সি, আবু হাসেম খান চৌধুরী, শঙ্কর মালাকার, শুভঙ্কর সরকার, অমিতাভ চক্রবর্তী, সন্তোষ পাঠক-সহ প্রদেশ কংগ্রেসের সব শীর্ষ পদাধিকারী তো ছিলেনই, ছিলেন সাংসদ মৌসন নূর, ছিলেন দলের সিংহভাগ বিধায়ক।

অধীর চৌধুরী কিছুটা দেরিতে পৌঁছন সভাস্থলে। তিনি যখন ঢুকছেন, ঘটনাচক্রে তখন ভাষণ দিচ্ছেন তাঁর একনিষ্ঠ অনুগামী তথা কংগ্রেস পরিষদীয় দলের মুখ্য সচেতক মনোজ চক্রবর্তী। অধীরকে মঞ্চের কাছাকাছি পৌঁছতে দেখেই তাঁর নামে স্লোগান তোলেন মনোজ। মুহূর্তে ভিড়ের মেজাজটাই বদলে যায়। তিন গুণ উৎসাহে ‘জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ’ শুরু হয় প্রদেশ কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতির নামে। মঞ্চে উঠে ভিড়ের সামনে করজোড়ে দাঁড়ানোর পরেও সেই একই সাড়া জমায়েতের। অধীরকে ঘিরে কংগ্রেস কর্মীদের এই উৎসাহ বুধবার আবার বুঝিয়ে দিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকদের কাছে অন্যতম সেরা ‘হিরো’ এখনও ‘মুর্শিদাবাদের রবিহনহুড’ই।

Advertisement

কংগ্রেসের সমাবেশে বুধবার কানায় কানায় রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ। নিজস্ব চিত্র।

তবে ধর্মতলার কংগ্রেসি সমাবেশে যে ঐক্যের আবহটা এ দিন দেখা গিয়েছে, তা-ও কিন্তু বেশ বিরল ছবি। অধীরকে নিয়ে জয়ধ্বনি চলল বেশ কিছু ক্ষণ, কিন্তু তা নিয়ে সোমেন শিবিরের কেউ বিন্দুমাত্র অস্বস্তি প্রকাশ করলেন না। যে আবদুল মান্নানের সঙ্গে অধীরের প্রায় মুখ দেখাদেখি বন্ধ হওয়ার জোগাড় হয়েছিল এক সময়ে, সেই মান্নান-ই এ দিন তড়িঘড়ি সোমেন মিত্রর গা ঘেঁষে চেয়ার পেতে দিলেন অধীরের জন্য। আর চেয়ারে বসার আগে নিজের ঘোষিত ‘গুরু’ সোমেনের পা ছুঁয়ে নিলেন অধীর। যত ক্ষণ মঞ্চে বসে থাকলেন, তত ক্ষণই খোশমেজাজে একান্ত আলাপে মেতে রইলেন গুরু-শিষ্য তথা প্রাক্তন-বর্তমান। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি পদে রদবদলের পরে সোমেন-অধীরের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হওয়া নিয়ে জল্পনা যখন তুঙ্গে, তখন প্রকাশ্য মঞ্চে এবং বড়সড় জমায়েতের সামনে এমন একটা ছবি তৈরি হওয়া কংগ্রেস কর্মীদের জন্য খুব বড় পাওনা।

আরও পড়ুন: ছিন্দওয়াড়ার মসিহা, নাকি গ্বালিয়রের মহারাজা, মুখ্যমন্ত্রী কে? বল সেই রাহুলের কোর্টেই

ধর্মতলার সমাবেশ থেকে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি এ দিন তীব্র কটাক্ষ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এক বারের জন্যও বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর নাম উচ্চারণ করেননি সোমেন। কখনও সম্ভাষণ উহ্য রেখেছেন, কখনও ‘দিদি’ বলে উল্লেখ করেছেন। আর কণ্ঠস্বরে প্রবল শ্লেষ নিয়ে বলেছেন, ‘‘তিন রাজ্যে রাহুল গাঁধীর জয় দেখে উনি এখন ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন। ভাবছেন এ কী হল? আমি তো চেয়েছিলাম কংগ্রেসকে সাইনবোর্ড করে দিতে। কিন্তু আজ ভারতের মানুষ আমাকে না বেছে রাহুল গাঁধীকে নেতা হিসেবে বেছে নিলেন!’’ ধর্মতলার সভামঞ্চ থেকে এ দিন ‘পরিবর্তনের পরিবর্তন’ ঘটানোর ডাক দিয়েছেন সোমেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার আন্দোলনের মধ্যে থাকতে জানুয়ারিতে প্রায় এক মাস ধরে গোটা বাংলায় ‘জেল ভরো’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। আর স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস একাই লড়বে, তৃণমূলের সঙ্গে জোট হবে না।

আরও পড়ুন: রথযাত্রা নিয়ে মুকুল, জয়প্রকাশের সঙ্গেই আলোচনায় বসতে হচ্ছে

অধীর চৌধুরীকেও পাওয়া গিয়েছে চেনা মেজাজে, চেনা ঝাঁঝে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে তীব্র সন্ত্রাসের অভিযোগ এ দিন ফের শোনা গিয়েছে বহরমপুরের সাংসদের মুখে। সেই প্রসঙ্গেই অধীর এ দিন বলেছেন, ‘‘১ কোটি ৭৬ লক্ষ মানুষ পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি। যাঁরা ভোট দিতে পারলেন না, আগামী লোকসভা নির্বাচনে কিন্তু তাঁরা সুদে-আসলে পুষিয়ে নেবেন।’’ তিন রাজ্যে কংগ্রেসের জয়ের প্রসঙ্গ টেনে অধীর বলেছেন, ‘‘রাহুল গাঁধী জিতেছেন, দিদির মনে শান্তি নেই আমি জানি। সবাই রাহুল গাঁধীকে অভিনন্দন দিচ্ছেন, শুধু দিদিভাই দিচ্ছেন না।’’ অধীরের কটাক্ষ, ‘‘বাংলা লুট করে দিদির পেট ভরছে না, তাই দিদি এ বার যাবেন দিল্লিতে। কিন্তু দিদি, দিল্লির চেয়ারটা রাহুল গাঁধীর জন্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে। ওখানে আর কোনও ভ্যাকেন্সি নেই।’’

এ দিনের সমাবেশে ভাষণ দিয়েছেন কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক তথা রাহুল ঘনিষ্ঠ সাংসদ গৌরব গগৈ। বিজেপি নয়, ভাষণের শুরুতেই গৌরবও এ দিন নিশানা করেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই। কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতারা বাংলায় এসে যা সচরাচর করেন না। মাইক্রোফোন হাতে নিয়েই রাহুলের নামে স্লোগান তোলেন গৌরব। সমর্থকদের গলার জোর বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে গৌরব বলেন, ‘‘নবান্নে যে নেত্রী রয়েছেন, তাঁকে শুনিয়ে বলুন, রাহুল গাঁধী জিন্দাবাদ।’’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরাসরি আক্রমণ করে গৌরবের মন্তব্য: ‘‘আপনি দিল্লিতে গিয়ে কংগ্রেস নেতাদের মিষ্টি খাওয়াবেন আর এখানে এসে কংগ্রেসকে গালি দেবেন, এই দ্বিচারিতার রাজনীতি আর চলবে না।’’ গৌরব এবং অধীর, দু’জনেই ঘোষণা করে গিয়েছেন— কংগ্রেসের পরবর্তী সমাবেশ ব্রিগেডে, রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বে।

তৃণমূলের সঙ্গে জোটের পক্ষে জোর সওয়াল করে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের বাড়িতে হাজির হয়ে গিয়েছিলেন যিনি, দক্ষিণ মালদহের সেই সাংসদ আবু হাসেম খান চৌধুরী এ দিন বলেন, ‘‘সংবাদমাধ্যমের কথা শুনবেন না। আমরা কংগ্রেসে জন্মেছি, কংগ্রেসেই মরব।’’ বহরমপুরের বিধায়ক মনোজ চক্রবর্তীর তীব্র কটাক্ষ, ‘‘ভূতেরও ভবিষ্যৎ আছে, কিন্তু তৃণমূলের কোনও ভবিষ্যৎ নেই।’’

সমাবেশ শেষে অলক্ষ্যেই সম্ভবত চওড়া হয়েছে সোমেন মিত্রের হাসি। চোখে পড়ার মতো জমায়েত করতে পেরেছেন, ঐক্যের ছবি তুলে ধরতে পেরেছেন। আর ধর্মতলার মঞ্চ থেকে শঙ্কর মালাকার, সন্তোষ পাঠকদের মতো জনভিত্তিসম্পন্ন একাধিক নেতা বলে গিয়েছেন, সোমেন মিত্রকে সামনে রেখেই আগামীর লড়াই। দেওয়ালের লিখন স্পষ্ট— ২০ বছর পর প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতিত্বে ফিরে ঘরটা ফের গুছিয়ে ফেলেছেন সোমেন। রাজনীতির একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ করার বার্তাও স্পষ্ট— ২০ বছর আগে যাঁকে দায়ী করে বাংলার কংগ্রেসকে সবচেয়ে বড় বিপদে ফেলেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এ বার সেই সোমেনকে সামনে রেখেই মমতাকে এ যাবৎ কালের সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা দেওয়ার জন্য কোমর বাঁধছে কংগ্রেস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন