সিবিএসই-র দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষা চলাকালীন পুরভোটের প্রচারে মাইক ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশন এক্তিয়ার বহির্ভূত কাজ করেছে বলে মনে করছেন পরিবেশকর্মী ও আইনজ্ঞদের একাংশ।
এর বিরুদ্ধে পরিবেশকর্মীদের কেউ জাতীয় পরিবেশ আদালতে, কেউ আবার কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হচ্ছেন আগামী সপ্তাহে। রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ অবশ্য এখনও আইনি পদক্ষেপ করার কথা ভাবেনি। তবে পর্ষদ সূত্রের খবর, মাইক ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে নির্দেশিকা জারি করার আগে তাদের সঙ্গে কমিশন আলোচনা না করে কেবল পরিবেশ দফতরের এক জন আধিকারিকের মত নিয়েছে।
এমনকী, ১৮ এপ্রিল কলকাতা পুরসভা নির্বাচনের দিনই পরীক্ষা রয়েছে। ওই দিন পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছবেন কী করে, তা নিয়ে বহু পরীক্ষার্থীই সংশয়ে।
বুধবার বিকেলে কমিশনের ওই নির্দেশিকা জারি হওয়ার পর বৃহস্পতিবার থেকে খোলা জায়গায় তারস্বরে মাইক বাজিয়ে প্রচার শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলি। পরীক্ষার্থীদের বাড়ির কাছে সেই প্রচারের কারণে প্রস্তুতির ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে অনেককেই।
বিড়লা হাইস্কুল থেকে ২২০ জন পড়ুয়া এ বার দ্বাদশ শ্রেণির সিবিএসই পরীক্ষা দিচ্ছেন। অ্যাকাউন্টেন্সি-সহ তিনটি পরীক্ষা তাঁদের এখনও বাকি। ওই স্কুলের অধ্যক্ষা মুক্তা নৈন শুক্রবার বলেন, ‘‘এমনিতেই শনিবার সর্বভারতীয় জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা রয়েছে। ভোটের প্রচারে চার দিকে তারস্বরে মাইক বাজলে পড়ুয়ারা কী ভাবে মনোযোগ দিতে পারবে, সে কথাই ভাবছি।’’ দমদম পার্কের বাসিন্দা এক ছাত্রী বলেন, ‘‘এখনও আমার বাংলা ও ভূগোল পরীক্ষা বাকি। পরীক্ষা শেষ ৯ এপ্রিল। এর মধ্যে মাইক বাজিয়ে ভোটের প্রচার হলে পড়াশোনায় মন দেব কী করে?’’
এই পরিস্থিতির জন্য কলকাতা হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় একহাত নিয়েছেন নির্বাচন কমিশনকেই। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ভোটের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশন শেষ কথা। কিন্তু মাইক ব্যবহার কখন করা যাবে কিংবা যাবে না, সেটা কমিশন ঠিক করতে পারে না। কমিশন এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ এক্তিয়ার-বহির্ভূত ও বেআইনি কাজ করেছে।’’ ভগবতীবাবুর কথায়, ‘‘এই ঘটনায় প্রমাণিত হল যে, রাজ্য নির্বাচন কমিশন আইন জানে না।’’
বস্তুত, বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিচারপতি সুজিত রায়বর্মনের ডিভিশন বেঞ্চ-ই ১৯৯৭ সালের নভেম্বর মাসে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং দিল্লি বোর্ডের দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির যাবতীয় পরীক্ষার ১৫ দিন আগে থেকে পরীক্ষা শেষ হওয়া পর্যন্ত খোলা জায়গায় মাইক, সাউন্ড বক্স বা অ্যামপ্লিফায়ার ব্যবহারের উপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নির্দেশিকা জারি করতে নির্দেশ দেয়। পরে সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীতের অনুষ্ঠান আয়োজকদের একটি সংগঠনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট জানায়, পরীক্ষা শুরুর তিন দিন আগে থেকে ওই নির্দেশিকা কার্যকর হবে। ২০০৭-এর এপ্রিলে অন্য একটি মামলায় হাইকোর্ট ফের জানায়, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক এবং দিল্লি বোর্ডের পরীক্ষাগুলির সময়ে খোলা জায়গায় মাইক বাজানোর অনুমতি দিয়ে ছাত্রসমাজের প্রতি অবিচার করা যাবে না। আবার তৃণমূলের তৎকালীন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতা হাইকোর্ট দিল্লি বোর্ডের পরীক্ষা চলাকালীনই বিধানসভা ভোটের প্রচারে খোলা জায়গায় মাইক ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু তখন হাইকোর্ট ওই নির্দেশে এটাও বলে যে, এই অন্তর্বর্তী নির্দেশকে ভবিষ্যতে নজির হিসেবে তুলে ধরা যাবে না এবং কেবল উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির জন্য বিশেষ পরিস্থিতিতে এই অনুমতি দেওয়া হল।
রাজ্য নির্বাচন কমিশনার সুশান্তরঞ্জন উপাধ্যায় অবশ্য এখনও অনড়। তাঁর বক্তব্য, ‘‘আদালত ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নির্দেশ বিবেচনা করে, পরীক্ষার্থীদের কথা ভেবে নিয়ন্ত্রিত মাইক ব্যবহারেরই অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সব ক’টি রাজনৈতিক দল আমাকে অনুরোধ করেছিল।’’
কিন্তু সেই অনুরোধ রাখতে গিয়ে কমিশন অনধিকার চর্চা এবং বেআইনি ও অনৈতিক কাজ করেছে বলে মনে করেন পরিবেশকর্ম়ী সুভাষ দত্ত। তাঁর কথায়, ‘‘প্রথমত, মাইক ব্যবহারের অনুমতি দিতে পারে কেবল পুলিশ-প্রশাসন। নির্বাচন কমিশন অনুমতি দেওয়ার কেউ নয়। আর গোটা ব্যাপারটাই বেআইনি ও অনৈতিক। আমি জাতীয় পরিবেশ আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করব।’’
নির্বাচন কমিশন সূত্রের খবর, ৬ থেকে ২০ এপ্রিল— এই সময়সীমার মধ্যে ন’দিন পরীক্ষা রয়েছে এবং মাত্র তিন হাজার পরীক্ষার্থী পরীক্ষা দেবেন বলেই ভোটের প্রচারে মাইক ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। পরিবেশকর্মী নব দত্ত ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এ তো ভয়ঙ্কর প্রবণতা। সংখ্যায় বেশি যারা, তারা অধিকার পাবে আর সংখ্যায় কম যারা, তারা বঞ্চিত হবে! এর বিরুদ্ধে আমরা,
সবুজ মঞ্চের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে আবেদন করছি।’’