ছুটির অফিস না অফিসের ছুটি, গুলিয়ে দিচ্ছে নবান্ন

ছুটি যেন ফুরোতেই চাইছে না! ২৯ দিনের মধ্যে সরকারি অফিস খোলা মাত্র ১১ দিন! সরকারি কর্মী মানেই ‘আসি যাই মাইনে পাই’— বাম আমলে লালিত এই ধারণা পাল্টে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Advertisement

পিনাকী বন্দ্যোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:২০
Share:

ছুটি যেন ফুরোতেই চাইছে না! ২৯ দিনের মধ্যে সরকারি অফিস খোলা মাত্র ১১ দিন!

Advertisement

সরকারি কর্মী মানেই ‘আসি যাই মাইনে পাই’— বাম আমলে লালিত এই ধারণা পাল্টে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিস্থিতি পাল্টানো দূরে থাক! রাজ্যবাসীর অভিজ্ঞতা বলছে, নয়া জমানায় কর্মচারীদের ছুটির সংখ্যা বাড়তে বাড়তে কর্মসংস্কৃতির কার্যত দফারফা হয়ে গিয়েছে। অনেকেরই কটাক্ষ, ‘‘এই সরকার ছুটির দেশেই রয়েছে।’’

সরকার গঠনের পর কিন্তু বলা হয়েছিল, প্রশাসনের কাছে বিভিন্ন প্রয়োজনে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসা সাধারণ মানুষ যাতে সুবিচার পান, তা নিশ্চিত করবে পরিবর্তনের সরকার। নবান্ন থেকে ব্লক অফিস পর্যন্ত কর্মসংস্কৃতি ফেরাতে কর্তাদের হুঁশিয়ারি থেকে শুরু করে নিত্য-নতুন নিয়ম চালু করার নজিরও কম দেখা যায়নি। বিরোধী দলের ডাকা বন্‌ধের দিন অফিস সচল রাখতে আগের রাত থেকে অফিসে কর্মীদের রাখার বন্দোবস্ত করেছেন প্রশাসনের কর্তারা। এমনকী, বন্‌ধের দিন কামাই হলে এক দিনের ছুটি কাটার হুমকি দিয়ে বিজ্ঞপ্তিও জারি করেছে নবান্ন। এত কিছুর পরেও সরকারি অফিসে কাজের পরিবেশ ফেরেনি। উল্টে কর্মীদের জন্য বাড়তি ছুটির ব্যবস্থা করে সরকার নিজেই গয়ংগচ্ছ ভাবকে প্রশ্রয় দিয়েছে বলে অভিযোগ।

Advertisement

মমতা সরকারের বদান্যতায় কত ছুটি পান সরকারি কর্মীরা?

নবান্নের তথ্য বলছে, অক্টোবরে দুর্গাপুজো উপলক্ষে টানা ১২ দিন সরকারি অফিস বন্ধ রাখার বন্দোবস্ত করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। এর মধ্যে লক্ষ্মীপুজো ছিল। এখন আবার কালীপুজো উপলক্ষে নিশ্চিন্তে ছুটি কাটাচ্ছেন আমলা-কর্মীরা। মঙ্গলবার কালীপুজো, বুধবার দেওয়ালির ছুটি। বৃহস্পতি ও শুক্রবার ভাইফোঁটা উপলক্ষে সরকারি অফিস বন্ধ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শনি ও রবিবারের সপ্তাহান্তিক ছুটি। সব মিলিয়ে টানা ছ’দিন! রাজ্য সরকারের ক্যালেন্ডার বলছে, ১৭ অক্টোবর থেকে ১৫ নভেম্বরের মধ্যে অফিস খোলা থাকছে মাত্র ১১ দিন। নবান্নের খবর, অনেক কর্মীই সোমবার একটি ক্যাজুয়াল লিভ নিয়ে আরও লম্বা ছুটির ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। তাঁরা গত সপ্তাহের শনি ও রবিবার ধরে টানা ন’দিন ছুটি উপভোগ করছেন। ছুটি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে এমন দরাজহস্ত দেখে নবান্নের চালু রসিকতা হল, পরের বার ক্ষমতায় এলে গ্রীষ্ম ও শীতের ছুটিও চালু হতে পারে রাজ্য সরকারি অফিসে।

এ বাদে কর্মীদের দৈনন্দিন কাজের জগতেও ছুটি ছুটি ভাব। সেই বাম আমলের মতোই দেরিতে এসে আগে অফিস ছাড়ার ট্র্যাডিশন অব্যাহত। অনেকের মতে, প্রশাসনের সদর দফতর মহাকরণ থেকে নবান্নে স্থানান্তরিত হওয়ায় কর্মীদের উপর কর্তাদের নিয়ন্ত্রণ আরও আলগা হয়ে গিয়েছে। মহাকরণে এখনও যে ক’টি দফতর রয়েছে, তার কর্মীরা কখন অফিসে আসেন, কখন চলে যান— হিসেব কেউ রাখে না। আর নবান্নের কর্মীদের কাজকর্ম নিয়ে প্রশাসনেরই একাংশের দাবি, সংবাদমাধ্যমের গতিবিধির উপরে নজর রাখতে সরকার যতটা তৎপর, কর্মীদের ক্ষেত্রে ততটাই অগোছালো।

কর্মসংস্কৃতির এমন অবস্থার ফেরে ভুগছেন সাধারণ মানুষই। বিভিন্ন মহলের অভিযোগ, এমনিতেই সরকারি পরিষেবা পেতে সাধারণ মানুষের কালঘাম ছোটে। এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে ফাইল যেতে মাস গড়িয়ে যায়। এই অবস্থায় টানা ছুটির জেরে পরিষেবা মাথায় উঠেছে। একাধিক দফতরের কর্তাদের অভিযোগ, অফিস টানা বন্ধ থাকায় অনেক প্রকল্পের অর্থ পেতে সময় লেগে যাচ্ছে। পিছিয়ে যাচ্ছে বহু কাজ। অনেকের মতে, টানা তিন-চার দিন ব্যাঙ্ক বন্ধ থাকলে দেশ তোলপাড় হয়ে যায়। আর এই সরকারে টানা ১০-১২ দিন ছুটি চললেও নবান্ন নির্বিকার!

বিরোধী কর্মী-ইউনিয়নগুলি অবশ্য মনে করে, ছুটি এবং কাজকর্ম নিয়ে এই সরকারের কিছু বলার থাকতে পারে না। কারণ, এই সরকার কর্মীদের মহার্ঘভাতা বাকি রেখেছে প্রায় ৫০%। তাই ছুটি বাড়িয়ে কর্মীদের খুশি রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। আইএনটিইউসি অনুমোদিত সরকারি কর্মী সংগঠন কনফেডারেশন অব স্টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজের নেতা মলয় মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কর্মীদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে, তার বদলে ছুটি দিয়ে মন জয় করতে চাইছে সরকার। এই ফন্দি কর্মীরা বুঝে গিয়েছেন।’’ বিজেপি প্রভাবিত সংগঠন সরকারি কর্মচারী পরিষদের সম্পাদক সঙ্কেত চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘ছুটি নয়, রুটি চাই। সরকার সেটা বুঝলেই মঙ্গল।’’

রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটির নেতা মনোজ গুহর গলাতেও অসন্তোষের সুর। তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘এই সরকার মেলা-খেলা-মোচ্ছবের সরকার। এদের থেকে এর বেশি কিছু আশা করেন না সরকারি কর্মীরা।’’ তবে তৃণমূল প্রভাবিত সরকারি কর্মী সংগঠন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশনের আহ্বায়ক সৌম্য বিশ্বাস অবশ্য এই অভিযোগ মানতে নারাজ। তাঁর দাবি, ছুটির ব্যবস্থা করে মানুষের উৎসবকে সরকার স্বীকৃতি দেয়। এতে অসুবিধের কিছু নেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন