গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে সন্দেশখালির উত্তাপ পৌঁছে গেল দিল্লিতেও। এলাকার ‘বেতাজ বাদশা’ শেখ শাহজাহান ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের বিরুদ্ধে স্থানীয় মহিলাদের সঙ্গে অশালীন আচরণের যে অভিযোগ উঠেছে, তা নিয়ে জাতীয় স্তরেও সুর চড়াতে শুরু করেছে বিজেপি। সন্দেশখালির মহিলাদের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সোমবার সেখানে গিয়েছিল রাজ্য মহিলা কমিশনের প্রতিনিধি দল। সেই দলটি ফিরে আসার পরেই ১০ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রাজ্য সরকার। যে কমিটি মূলত সন্দেশখালির মহিলাদের তোলা শ্লীলতাহানির অভিযোগের বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। কমিটির নেতৃত্বে থাকবেন ডিআইডি পদমর্যাদার এক মহিলা অফিসার।
গত সপ্তাহে দফায় দফায় অশান্তির ঘটনা ঘটেছিল সন্দেশখালিতে। রাস্তায় নেমে আন্দোলনে শামিল হন গ্রামের মানুষ। সেই সব বিক্ষোভকারীদের মধ্যে একেবারে সামনের সারিতে দেখা গিয়েছিল বহু মহিলাকে। তাঁদের অভিযোগ ছিল, এলাকার কম বয়সি সুন্দরী মহিলাদের ‘আলাদা’ চোখে দেখতেন শাহজাহানের শাগরেদ শিবপ্রসাদ হাজরার বাহিনীর লোকেরা। জোর করে তাঁদের মিটিং-মিছিলে ডেকে নিয়ে যাওয়া তো বটেই, রাতের দিকেও বাড়িতে ডেকে পাঠানো হত। না গেলেই দেওয়া হত হুমকি। শ্লীলতাহানিরও অভিযোগ তুলেছিলেন মহিলাদের একাংশ। সেই সব অভিযোগ নিয়ে রাজ্য জুড়ে তো বটেই, এ বার জাতীয় স্তরেও সরব হয়েছেন বিরোধীরা। বিষয়টি নিয়ে সোমবার দিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠক করেছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি। শাসকদল তৃণমূল ও রাজ্য প্রশাসনকে বিঁধে তিনি বলেন, ‘‘বাংলায় তৃণমূলের লোকেরা যে ভাবে মহিলাদের উপরে অত্যাচার করছে, তা জানার পরেও রাজ্য সরকার চুপ। ১৪৪ ধারা জারি হওয়ায় এলাকার বাসিন্দারা নিজেদের কথা সংবাদমাধ্যমের সামনে বলতে পারছেন না।’’ সন্দেশখালির মহিলাদের সঙ্গে কী কী ঘটেছে, তা গোটা দেশের জানা উচিত বলেও মন্তব্য করেন স্মৃতি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর মন্তব্যের পাল্টা জবাব দিয়েছেন তৃণমূলের বহিষ্কৃত সাংসদ মহুয়া মৈত্র। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, মণিপুরের সন্ত্রাস, বিলকিস বানো, মহিলা কুস্তিগির এবং ব্রিজ ভূষণ নিয়ে স্মৃতিরা দর্শকের ভূমিকায় ছিলেন কেন?
এ দিকে, সন্দেশখালির মহিলাদের শ্লীলতাহানির অভিযোগ খতিয়ে দেখতে সোমবার সেখানে গিয়েছিল রাজ্যের মহিলা কমিশনের প্রতিনিধি দল। গিয়েছিলেন কমিশনের চেয়ারপার্সন লীনা গঙ্গোপাধ্যায়ও। সেখানে ঘুরে ঘুরে মহিলাদের সঙ্গে কথা বলেন তাঁরা। পরে লীনা সংবাদমাধ্যমে বলেন, ‘‘আমরা গিয়েছিলাম সন্দেশখালি। এখানে আসার আগে শ্লীলতাহানির অভিযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু এখানে এসে এ রকম কাউকে পাইনি, যাঁরা আমাদের সামনে সেই অভিযোগ করেছেন। জানতে পারলাম, মহিলাদের রাতে ডেকে নিয়ে গিয়ে বাড়ির কাজ, ব্যক্তিগত কাজ করানো হত। কিন্তু শ্লীলতাহানি সংক্রান্ত অভিযোগ আমরা পাইনি।’’ এর পরেই সেখানে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসও গিয়েছিলেন। তিনিও সেখানকার পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখেন। তাঁকে কাছে পেয়ে এলাকার পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ উগরে দেন কয়েক জন মহিলা। তাঁরা শাহজাহান ও শিবুর গ্রেফতারির দাবি জানিয়েছেন। তাঁদের কথা শুনে রাজ্যপাল বোসও দ্রুত পদক্ষেপের আশ্বাস দিয়েছেন।
সোমবার সন্দেশখালির ঘটনাক্রম নিয়ে মুখ খুলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। মন্তব্য করেছেন রাজ্যপালের সন্দেশখালি সফর নিয়েও। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘যে যেখানে খুশি যেতেই পারেন। আমিও রাজ্য মহিলা কমিশনকে পাঠিয়েছিলাম। তারা রিপোর্ট দিয়েছে। আর যাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ, তাদের গ্রেফতার করেছে পুলিশ।’’ ঘটনাচক্রে, এর পর সন্ধ্যাতেই রাজ্য পুলিশের তরফে সন্দেশখালির ঘটনা নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানানো হয়।
অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শুক্রবার রাত থেকে সন্দেশখালিতে ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ইন্টারনেটও। সোমবারও সেই অবস্থার কোনও পরিবর্তন হল না। ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার চেয়ে কলকাতা হাই কোর্টে মামলা করেছে সিপিএম। মঙ্গলবার তার শুনানি রয়েছে। গোটা পরিস্থিতি নিয়ে বিজেপিও সোমবার পথে নেমেছে। সন্দেশখালিকাণ্ডের প্রতিবাদে সকালে বিধানসভায় বিক্ষোভ দেখান বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর নেতৃত্বে বিজেপি বিধায়কেরা। ‘সন্দেশখালির সঙ্গে আছি’ লেখা টিশার্ট গায়ে দিয়ে বিধানসভার অধিবেশনে ঢোকেন তাঁরা। বিধানসভার ভিতরে তাঁরা হুইসল বাজিয়েও বিক্ষোভ দেখান। পরে ওয়াকআউট করে তাঁরা। এর জন্য শুভেন্দু-সহ ছ’জন বিধায়ককে সাসপেন্ড করেন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে বিধানসভা থেকে বেরিয়ে সন্দেশখালির উদ্দেশে রওনা দেন বিজেপি বিধায়কেরা। শুভেন্দুও ছিলেন। কিন্তু সন্দেশখালির ঢোকার অন্তত ৬০ কিলোমিটার আগে বাসন্তী হাইওয়েতে তাঁদের আটকে দেওয়া হয়। পরে সন্ধ্যার দিকে ফিরে যান বিজেপি বিধায়কেরা। সোমবার সন্দেশখালির দু’টি ব্লকে ১২ ঘণ্টার বন্ধ পালন করেছে সিপিএমও।
সন্দেশখালিতে হিংসায় উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে রবিবারই প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক নিরাপদ সরকারকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারই প্রতিবাদে বন্ধ ডেকেছিল সিপিএম। এর প্রতিবাদে সোমবার বামেরা রাজ্যের নানা জায়গায় বিক্ষোভও দেখান। নিরাপদের পাশাপাশি সন্দেশখালিকাণ্ডে তৃণমূলের উত্তম সর্দার ও বিজেপির বিকাশ সিংহকেও গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। সোমবার তাঁদের বহিরহাট মহকুমা আদালতে হাজির করানো হয়। উত্তম ও বিকাশকে আদালত জামিন দিলেও নিরাপদকে তিন দিনের পুলিশি হেফাজতে পাঠানো হয়েছে। সন্দেশখালিতে যাঁকে নিয়ে এত কাণ্ড, সেই শাহজাহান এখনও পলাতক। সোমবার তাঁর ইডির দফতরে হাজিরা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এ বারও হাজিরা এড়িয়ে কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন শাহজাহান। আদালতে তাঁর আইনজীবী জানিয়েছেন, ইডি যদি বলে তাঁর মক্কেলকে গ্রেফতার করা হবে না, তা হলে তিনি হাজিরা দিতে পারেন। অথবা আদালতে এই আবেদনের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত ইডি তাঁর বিরুদ্ধে সমন জারি করা থেকে বিরত থাকুক। এই মামলার পরবর্তী শুনানি ২৩ ফেব্রুয়ারি।
সন্দেশখালিতে রাজ্যপাল
সফর কাটছাঁট করে সোমবারই কেরল থেকে কলকাতায় ফিরে সন্দেশখালি গিয়েছেন রাজ্যপাল। সোমবার সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ কলকাতা বিমানবন্দরে নামেন বোস। তার পর সেখান থেকে তিনি সন্দেশখালির উদ্দেশে রওনা দেন। মালঞ্চের কাছে পৌঁছতেই রাজ্যপালের কনভয় ঘিরে বিক্ষোভ দেখান স্থানীয় মহিলারা। রাস্তার দু’পাশে প্ল্যাকার্ড, পোস্টার হাতে ১০০ দিনের বকেয়া মেটানোর দাবি তোলেন তাঁরা। স্থানীয় সূত্রে খবর, বিক্ষোভ করতে করতে রাজ্যপালের কনভয়ের সামনে চলে যান বিক্ষোভকারীরা। যার জেরে বোসের কনভয় থেমে যায়। মিনিট পাঁচেক রাস্তায় আটকেও ছিল কনভয়। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে বেরোতে পারেন রাজ্যপাল। তিনি সন্দেশখালি পৌঁছতেই তাঁকে ঘিরে নিজেদের কথা বলতে থাকেন স্থানীয় মহিলারা। কেউ জানান দিনের পর দিন কী ভাবে তাঁদের উপর অত্যাচার হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতার কথা। কেউ আবার জানান, কী ভাবে তাঁদের সঙ্গে অশালীন আচরণ করেছেন শাহজাহান, শিব ও ধৃত উত্তম সর্দারেরা। এক মহিলার কথায়, ‘‘আপনারা এখন আছেন বলে আমরা নিজেদের কথা বলতে পারছি। কিন্তু আপনারা এখান থেকে চলে গেলেই আবার আগের মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে। ওরা আরও অত্যাচার করবে আমাদের উপর। কিছু একটা করুন, যাতে ওরা গ্রেফতার হয়। আমরা ওদের কঠোর শাস্তি চাই। ফাঁসি চাই আমরা।’’ তিনি বলেন, ‘‘আমি কথা দিচ্ছি, যাঁরা জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করা হবে। আমার যা ক্ষমতা আছে, তা দিয়ে আমি ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’’
বিধানসভায় শুভেন্দুদের প্রতিবাদ
সোমবার বাজেট অধিবেশনে ‘সন্দেশখালি সঙ্গে আছি’ লেখা টিশার্ট গায়ে দিয়ে বিধানসভার বাজেট অধিবেশনে ঢোকেন বিজেপি বিধায়কেরা। তাতে আপত্তি জানান স্পিকার। এর পরেই বিক্ষোভ শুরু করেন বিজেপি বিধায়কেরা। স্লোগান দেওয়ার পাশাপাশি হুইস্ল বাজাতে শুরু করেন তাঁরা। এর পর বিধানসভা থেকে বিজেপি বিধায়কেরা ওয়াকআউট করেন। এর পরেই বিধানসভার মুখ্যসচেতক নির্মল ঘোষ বিজেপির পুরো পরিষদীয় দলকে সাসপেন্ড করার প্রস্তাব দেন। পরে পরিষদীয় মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় সেই প্রস্তাব সংশোধন করে শুভেন্দু-সহ ছ’জন বিধায়ককে সাসপেন্ড করার প্রস্তাব দেন। ওই ছ’জনের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুললে সাসপেন্ড করেন স্পিকার। এই নিয়ে সরব হন বিজেপি বিধায়কেরা। শুভেন্দুর কথায়, ‘‘রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় আসেন না। আজ পর্যন্ত বিজেপি বিধায়কদের স্বরাষ্ট্র দফতরের কোনও প্রশ্নের জবাব দেন না তিনি। বিধানসভায় সন্দেশখালি নিয়ে প্রশ্নের জবাবও দেননি। প্রশ্ন তুলে আমরা সাসপেন্ড হয়েছি। সন্দেশখালির মা-বোনেদের সম্মান বাঁচাতে যদি এ ভাবে সাসপেন্ড করা হয়, তা হলে ভয় করব না, লড়াই করে যাব।’’ শুভেন্দুদের সাসপেন্ড প্রসঙ্গে শোভনদেব বলেন, ‘‘বিধানসভার স্পিকার অধিবেশনের শুরুতেই বিরোধী দলের বিধায়কদের রাজনৈতিক স্লোগান লেখা টিশার্ট খুলে ফেলতে অনুরোধ করেন। কিন্তু তাঁরা রাজি হননি। স্লোগান দিতে থাকেন। কাগজ ছিঁড়ে ওড়াচ্ছিলেন। স্পিকার বার বার বিরোধী দলনেতাকে অনুরোধ করতে থাকেন, বিশৃঙ্খলা বন্ধ করতে। এর পর আমি বিজেপির ছ’জন বিধায়কের বিরুদ্ধে স্পিকারের কাছে প্রস্তাব পেশ করি।’’
আটকানো হল শুভেন্দুদের
সন্দেশখালি যাওয়ার পথে আটকে দেওয়া হয় শুভেন্দু অধিকারী-সহ বিজেপির বাকি বিধায়কদের। সন্দেশখালি থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার আগে বাসন্তী হাইওয়েতেই বিজেপি বিধায়কদের গাড়ি আটকে দিল পুলিশ। এই নিয়ে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছেন বিরোধী দলনেতা। তাঁর দাবি, ভয় পেয়ে আটকানো হয়েছে। তিনি এবং বাকি বিধায়কেরা বাসন্তী হাইওয়েতেই বসে থাকেন। বিরোধী দলনেতা বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভয় পেয়েছেন। ভয়ে থরথর করে কাঁপছেন। তাই সন্দেশখালি যাওয়ার ৬০ কিলোমিটার আগেই আটকানো হল। এখানে ১৪৪ ধারা নেই। কেন আটকানো হল বুঝতে পারছি না। আমরা এখানেই বসে থাকব।’’ পরে সন্ধ্যার দিকে ফিরে যান শুভেন্দুরা।
রাতে নাটকীয় মোড়
সন্দেশখালিতে অশান্তিতে প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে শনিবার গ্রেফতার হন বিজেপি নেতা বিকাশ সিংহ। সোমবার তাঁকে জামিন দেয় আদালত। পাশাপাশি শনিবার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া বহিষ্কৃত তৃণমূল নেতা উত্তম সর্দারকেও জামিনে মুক্তি দেয় আদালত। কিন্তু আদালত থেকে বেরনোর সঙ্গে সঙ্গেই বিকাশকে আবার গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশকে ঘিরে ধরেন বিজেপির নেতাকর্মীরা। শুরু হয় উত্তেজনা। তার মধ্যে কার্যত টানাহ্যাঁচড়া করে গাড়িতে তোলা হয় বিজেপি নেতাকে। উত্তমকেও পরে আবার গ্রেফতার করে পুলিশ। এদের দু’জনকেই বসিরহাট থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।