Sundarbans

সুন্দরবনে পরিবেশ-বান্ধব পরিকাঠামো গড়তে চায় রাজ্য

গত প্রায় ১৫ বছরে আয়লা, বুলবুল, আমপান, ইয়াসের মতো ঝড় তো সামলাতে হয়েইছে, এ ছাড়াও আরও কিছু বিপর্যয় সুন্দরবন ছুঁয়ে চলে গিয়েছে বাংলাদেশ বা মায়নমারের দিকে।

Advertisement

চন্দ্রপ্রভ ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২৩ ০৭:২৫
Share:

পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিকেই সুন্দরবন উন্নয়নের মূল হাতিয়ার করতে চাইছে রাজ্য সরকার। —ফাইল চিত্র।

যত্রতত্র কংক্রিটের সেতু-পরিকাঠামো নয়। এলাকার চরিত্র অনুযায়ী পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিকেই সুন্দরবন উন্নয়নের মূল হাতিয়ার করতে চাইছে রাজ্য সরকার।

Advertisement

প্রথমত সেতু নয়, সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী সুন্দরবনের দ্বীপগুলি থেকে উৎপাদিত সামগ্রী নৌকোয় এনে ভাসমান জেটির মাধ্যমে তোলা হবে পাড়ে। এক বিশেষজ্ঞের কথায়, “একটি সেতু করতে তিন-চার বছর সময় লাগে। কিন্তু ভাসমান জেটি ছয় থেকে ন’মাসের মধ্যে হয়। আবার সেতুর খরচের ১০ ভাগের এক ভাগ খরচে তা তৈরি সম্ভব। পরিবেশের পক্ষেও তা উপযুক্ত।’’ এ ছাড়াও বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি ইটের ‘ব্লক’ দিয়ে সমুদ্রবাঁধের সুরক্ষা-ঢাল তৈরি হবে। সমুদ্রস্রোতের সঙ্গে আসা পলি বিশেষ পদ্ধতিতে ছেঁকে নিয়ে বাঁধের উচ্চতা ও বাঁধুনি আরও শক্তপোক্ত করা হবে। পলিস্তরের কিছুটা অংশে ম্যানগ্রোভ বীজ ছড়িয়ে দ্বিতীয় স্তরের নিরাপত্তাবলয় তৈরি করবেন বিশেষজ্ঞরা। সেটাও হবে পরিবেশ-বান্ধব। এ ভাবে প্রায় ৪৬০০ কোটি টাকা বরাদ্দে সুন্দরবন বাঁচানোর রূপরেখা তৈরি হয়েছে।

গত প্রায় ১৫ বছরে আয়লা, বুলবুল, আমপান, ইয়াসের মতো ঝড় তো সামলাতে হয়েইছে, এ ছাড়াও আরও কিছু বিপর্যয় সুন্দরবন ছুঁয়ে চলে গিয়েছে বাংলাদেশ বা মায়নমারের দিকে। যার প্রভাবে প্রাকৃতিক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি সেখানকার মাটি লবনাক্ত হয়ে যাওয়ায় প্রশ্নের মুখে পড়েছে সেখানকার মানুষের জীবন-জীবিকাও। বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে আগামীতেও। এই অবস্থায় আমপান-ইয়াসের পরে সুন্দরবনের জন্য যে ‘মাস্টার প্ল্যান’ তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছিল, সেখানেই দ্বিমুখী পদক্ষেপ করতে চলেছে রাজ্য।

Advertisement

প্রশাসনিক সূত্র জানাচ্ছে, এই প্রকল্পে সুন্দরবনের উচ্চ বদ্বীপে অনেকগুলি নদী সংস্কারের যে কাজ হবে তাতে মোট বরাদ্দ থাকছে ১১২০ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা (১৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)। তার মধ্যে ৩৩৬ কোটি ১৫ লক্ষ টাকা (৩০%) রাজ্যের বরাদ্দ, বাকিটা এডিবি-র সহজ ঋণ। তার সঙ্গে নিম্ন বদ্বীপে বাঁধ পরিকাঠামো-সহ মাটিতে জমা নুনের মাত্রা কমাতে যে কাজ হবে, তাতে বরাদ্দ থাকছে ৩৭৩৫ কোটি টাকা (৪৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)। তার মধ্যে রাজ্যের বরাদ্দ ১১২০ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা(৩০%)। বাকিটা বিশ্বব্যাঙ্কের সহজ ঋণ। প্রকল্পের সময়সীমা পাঁচ বছর।

প্রশাসনিক সূত্র জানাচ্ছে, সমুদ্রের জল ঢুকে সুন্দরবনের মাটি লবনাক্ত করছে। যে সমস্যা দীর্ঘমেয়াদী। উচ্চ বদ্বীপ এলাকার অনেকগুলি নদী, খাল-বিল মজে যাওয়ায় তার মিষ্টি জল সেই ক্ষত মেরামত করতে পারছে না। প্রথমেই সেই নদীগুলির সংস্কারের পরিকল্পনা হয়েছে। যমুনা, বিদ্যাধরী, ওয়ালি, আদিগঙ্গা, পিয়ালী, দক্ষিণ সরস্বতী, কটকুন্তি ও সুতী খাল এবং আরও অনেক খালবিলগুলিকে পলিমুক্ত করে মিষ্টি জলের প্রবাহ সুন্দরবনমুখী করা হবে। ঠেকানোর চেষ্টা হবে হুগলি, ইছামতির পাড় ভাঙন। প্রশাসনের এক কর্তার কথায়, “মিষ্টি জলের প্রবাহ বাধামুক্ত করতে পারলে মাটিতে মেশা নুনের পরিমাণ কমিয়ে ফেলা সম্ভব। তা করা গেলে পরবর্তী পদক্ষেপটাও কার্যকর হবে। এই কাজে বরাদ্দ প্রায় ১১২০ কোটি টাকা। যাতে এডিবির ঋণ এবং রাজ্য সরকারের বরাদ্দ রয়েছে।”

দ্বিতীয় পদক্ষেপে নিম্ন ব দ্বীপে সমুদ্রবাঁধ সংস্কারের ক্ষেত্রে নেদারল্যান্ডের একটি সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করেছে রাজ্য। তাতে ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে থাকা কংক্রিটের বাঁধের গায়ে ইটের ‘ব্লক’ বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি করে সেই বাঁধের সুরক্ষা-ঢাল হিসাবে দেওয়া থাকবে। সেচ দফতরের বিশেষজ্ঞদের অনুমান, এই প্রকল্পে প্রায় ২৫০ কিলোমিটার বাঁধ প্রস্তুত করা সম্ভব। পাশাপাশি, ওই বাঁধের গায়ে আসা সমুদ্রস্রোতে মিশে থাকা পলি বিশেষ পদ্ধতিতে ছেঁকে নেওয়া হবে। জমা সেই পলিকে কাজে লাগিয়ে বাঁধের বাঁধুনি আরও শক্তপোক্ত করা হবে। পলিস্তরের কিছুটা অংশে ম্যানগ্রোভ বীজ ছড়িয়ে দ্বিতীয় স্তরের নিরাপত্তাবলয় তৈরি হবে। প্রশাসনের এক বিশেষজ্ঞের বক্তব্য, “পরিবেশের সঙ্গে মানানসই ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। না হলে কৃত্রিম কোনও পরিকাঠামোই স্থায়ী হবে না। এই কাজে বরাদ্দ ৩৭৩৫ কোটি টাকা। যাতে বিশ্বব্যাঙ্কের ঋণ ও রাজ্যের বরাদ্দ রয়েছে।”

এরই সমান্তরালে দ্বীপগুলিতে থাকা প্রায় ৭০০ কিলোমিটার খাঁড়ির সংস্কার হয়েছে ইতিমধ্যেই। এতে বৃষ্টির মিষ্টি জল যেমন ধরে রাখা যাবে, তেমনই প্লাবন হলে নোনা জলের ভারসাম্য বজায় রাখতেও তা হবে সহায়ক। খাঁড়ি সংলগ্ন এলাকাগুলিতে কৃষি, উদ্যানপালন ও মৎসচাষের উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে দেবে রাজ্যই। পাড় থেকে পণ্য পরিবহণের জন্য রাস্তা তৈরি হবে। সব চাষই আর্গানিক পদ্ধতিতে করানো হবে। উৎপাদন সংগ্রহ করে তা বাজারজাত করার দায়িত্ব প্রশাসনের। বিনিময়ে লাভের অর্থ বুঝে নেবেন চাষের সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা। সুন্দরবনকে অর্গানিক হাব হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা হচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন