West Bengal Lockdown

জেলের গল্প শুনেছি, এখন যেন নিজেই ‘জেলে’

দুই মামার মধ্যে একজন রাজস্থানের দেউলি ডিটেনশান ক্যাম্পে আট বছর কারাবাস করেছিলেন।

Advertisement

দেবব্রত ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২০ ০২:০৭
Share:

প্রতীকী ছবি।

মায়ের মুখ থেকে শুনেছিলাম স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় দুই মামা কারাবাস করেছিলেন। তখন ভাবতেও পারিনি নিজের বাড়িতেই নিজেকে বন্দি হয়ে থাকতে হবে।

Advertisement

দুই মামার মধ্যে একজন রাজস্থানের দেউলি ডিটেনশান ক্যাম্পে আট বছর কারাবাস করেছিলেন। কারাবাসে থাকাকালীন ইংরেজিতে এমএ পরীক্ষা দিয়ে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলেন। আর এক মামা ছিলেন বালুরঘাট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। আজকে মায়ের মুখ থেকে শোনা দুই মামার কারাবাসের সেই গল্পগুলো মনে পড়ছে। আমি আমার এই ৮০ বছরের জীবনে প্রথম জেল খাটছি বলে মনে হচ্ছে। তবে একা নই, স্ত্রীও আছেন আমার কষ্টের সঙ্গী।

আমাদের মেয়ে আমেরিকার সিনসিনাটিতে থাকে। ওখানে মেয়ে জামাই আর ১৪ বছরের নাতনি আছে। ওদের কথা ভেবে কষ্ট হচ্ছে আমাদের দু’জনের। দুশ্চিন্তা হচ্ছে। শেষবার ২০১৭ সালে ওখানে গিয়েছিলাম। প্রতিদিনই সন্ধ্যাবেলায় কথা হয়। মেয়েদের ওখানে ওতোটা প্রকোপ না থাকলেও ওরা মাস খানেক ধরে ঘরবন্দি রয়েছে। আমার আশি বছর বয়স হয়েছে। আমি চলে গেলে কিছু আসে যায় না। কিন্তু ওদের কথা ভেবে বড় বেশি কষ্ট হচ্ছে।

Advertisement

লকডাউন শুরুর আগে, যেদিন রবিবার ২২ মার্চ জনতা কার্ফু হল তার আগে ২১ মার্চ পর্যন্ত বইয়ের দোকানে গিয়েছি। রাত্রিবেলায় যেখানে প্রতিদিন আড্ডা মারি সেখানে আড্ডাও মেরেছি। ২২ তারিখের পর সেসব বন্ধ। কারও সঙ্গে দেখা
সাক্ষাৎ নেই।ফোনে একটু আধটু কথা হচ্ছে সবার সঙ্গে। অনেকেই আমাকে বেরোতে মানা করেছেন।
প্রতিদিন রাতে নিশ্চিন্তিপুরে আমাদের সেই আড্ডার জন্য মন খারাপ করছে। আড্ডা ভেঙে গিয়েছে। ওখানে আমার বন্ধু অমিত চক্রবর্তী, ভোলানাথ দে, মুকুল কর্মকার, দেবাদীন বসুরা আসেন। দেশ-বিদেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি ঘটনা, কবিতা, সাহিত্য, বিঞ্জান, সংস্কৃতি নিয়ে আলোচনা হয়। রাজনীতি সেইভাবে প্রকট ভাবে আসত না। রসবোধ প্রচণ্ডভাবে থাকে। সাধারনত সাড়ে আটটা থেকে পৌনে দশটা– দশটা পর্যন্ত আড্ডা চলত।

রাত সাড়ে আটটার মধ্যে সকলে চলে আসতেন। ওখানে বসার একটি জায়গা আছে। ওখানে অন্যেরা বসে থাকলেও সাড়ে আটটার সময় আমাদের দেখলেই জায়গাটা ছেড়ে দিতেন। চা মাঝে সাঝে আসত। একজন লেবু চা নিয়ে আসতেন। না পেলে মন খারাপ করত। সেই আড্ডার জন্যই মন খারাপ করছে। মনে হচ্ছে, লকডাউন চলুক কিন্তু নিয়ম মেনে আড্ডার জন্য এক ঘণ্টা ছেড়ে দিলে কষ্টটা হত না।

পাড়ায় আনাজ বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতা আসেন। চাল কেনা আছে। এখন পুরনো বই পড়ে সময় কাটছে। স্ত্রীর সঙ্গে গল্পগাছা করি। রবীন্দ্রনাথকে আবার পড়ছি। মনের শান্তি, প্রাণের আরাম। উনি তো জীবনে অনেক দুঃখ দেখেছেন। রাতে ইউটিউবে পুরনো ইংরেজি সিনেমা দেখি। এই ভাবেই দিন কাটাচ্ছি আপাতত।

তবে, নিজের জন্য চিন্তা করছি না। দীর্ঘদিন কলেজে পড়িয়েছি। অনেক লোকের ভালোবাসা পেয়েছি। এই বয়সে এসে একটা কথা মনে হচ্ছে, একটা অদৃশ্য ক্ষুদ্র প্রাণী শুধু মানুষকে বেছে নিয়েছে। আসলে মানুষ তো বহু প্রজাতিকে শেষ করে দিয়েছে। হতে পারে এটা একটা ‘পোয়েটিক জাস্টিস’। আমার মনে হচ্ছে তাই বললাম। তবে সবাইকে বলব ঘরে বসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। সেই সঙ্গে এই দুর্দিনে গরিব মানুষের পাশে থাকুন। আমিও যথাসাধ্য ভাবে পাশে থাকার
চেষ্টা করছি।

লেখক প্রাক্তন কলেজশিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন