পিতৃহারা: খোকন সিকদারের কফিনবন্দি দেহাবশেষ আঁকড়ে ছেলে অভ্র (বাঁ দিকে)। মঙ্গলবার তেহট্টের ইলশামারিতে। ছবি: কল্লোল প্রামাণিক
অবশেষে ঘরে ফিরল ইরাকে আইএস জঙ্গিদের হাতে নিহত দু’জনের দেহাবশেষ। দু’জনেই নদিয়ার। দু’জনেরই ঘরে স্ত্রী-সন্তানেরা এত দিন অপেক্ষায় ছিলেন।
ভীমপুরের মহখোলায় বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া টিনের ঘর দীপালি টিকাদারের। গত ২০ এপ্রিল সুষমা স্বরাজ যখন রাজ্যসভায় জানালেন, ইরাকে জঙ্গিদের হাতে অপহৃতেরা কেউ বেঁচে নেই, দীপালি উত্তর ২৪ পরগনার কাঁচড়াপাড়ায় সুসংহত শিশু বিকাশ প্রকল্পের প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। বাড়ি ফিরেও দুই সন্তানের মুখ চেয়ে কান্না চেপে ছিলেন।
মঙ্গলবার সমর টিকাদারের কফিনবন্দি দেহাবশেষ যখন উঠোনে নামানো হল, আর থাকতে পারলেন না দীপালি। ডুকরে কেঁদে উঠলেন। চার বছরের প্রতীক্ষা শেষ। সকাল থেকে কোল ঘেঁষে বসে ছিল বছর সাতেকের মেয়ে শর্মিষ্ঠা। বাবার মুখটাই তার মনে পড়ে না। বছর পনেরোর ছেলে সুদীপ্ত হাঁসখালিতে মামার বাড়িতে থাকে। তিন দিন আগে বাড়ি এসেছে। কিন্তু কথাই বলছে না।
তেহট্টের ইলশামারি গ্রামের খোকন সিকদার বাড়ি ছেড়েছিলেন সাত বছর আগে। ছোট থেকেই নানা জায়গায় ঘুরেছেন, কখনও কলকাতা তো কখনও মালয়েশিয়া। বাইরে কাজ করে কাঠা পাঁচেক জমি কিনেছিলেন। টিনের একটা ঘরও তুলেছিলেন। কিন্তু বছরখানেকের বেশি সেখানে থাকতে পারেননি। নির্মাণকর্মীর কাজ নিয়ে চলে যান ইরাকে। প্রতি শুক্রবার বাড়িতে ফোন করতেন। আর টাকা পাঠাতেন নিয়মিত।
শোকাহত: স্বামী সমর টিকাদারের কফিন দেখে মেয়েকে জড়িয়ে কান্না দীপালির। ভীমপুরের মহখোলায়। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
২০১৪-র জুনে মসুল শহরে আরও ৩৭ জন ভারতীয়ের সঙ্গে সমর এবং খোকনও অপহৃত হন। চার বছর ধরে দিন গুনেছেন খোকনের মা শোভা আর স্ত্রী নমিতা। গুনেছে তাঁর দুই ছেলেমেয়ে, নয় বছরের অভ্র এবং বছর উনিশের রিতাও। দু’বছর আগে নমিতা অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীর কাজ নেন। কাঁদতে-কাঁদতে তিনি বলেন, ‘‘যদি সরকার সাহায্য না করে, ছেলেমেয়ের পড়া ছাড়াতে হবে।’’ স্থানীয় তৃণমূল বিধায়ক গৌরীশঙ্কর দত্ত কফিন নিয়ে বাড়িতে আসার পথে এলাকার মানুষ পথ আটকে জানতে চান, পঞ্জাব যদি পাঁচ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়, রাজ্য সরকার তা দিচ্ছে না কেন?
শোক ছাপিয়ে একই আর্তি ঝরেছে দীপালির গলাতেও। দেহাবশেষ নিয়ে বাড়িতে এসেছিলেন কারামন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস। তাঁর পায়ে আছড়ে পড়ে দীপালি বলেন, “চারটে বছর অপেক্ষা করলাম মানুষটা আসবে বলে। এত টাকা দেনা। বাঁচব কী করে?”
বহু কষ্টে জমি-বাড়ি করেও নিজে থাকতে পারেননি খোকন। পরিজনেরা তাই ঠিক করেন, ওই জমিতেই তাঁকে তাঁরা রেখে দেবেন। সৎকার না করে উঠোনের এক পাশে তাঁর দেহাবশেষ সমাহিত করা হয়েছে।