বাঁচানো গেল না বাঘুতকে, শুরু আক্ষেপ

মহুল গাছের তলায় পোড়া মাটির হাতি-ঘোড়ার ছলনে বাঘ দেবতার উদ্দেশ্যে আতপ চাল-গুড়-দুধ-দুর্বা ঘাসের নৈবেদ্য নিবেদন করে বর্ষীয়ান সন্তোষবাবু জানালেন, বল্লম খুঁচিয়ে বাঘুতকে মেরে ফেলার মতো হীন কাজকে কখনওই সমর্থন করা যায় না।

Advertisement

কিংশুক গুপ্ত

ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৮ ০১:২০
Share:

গড়: ঘোড়াজাগির গরাম থানে।নিজস্ব চিত্র

চৈত্র সংক্রান্তির সকালে গাঁয়ের গরাম থানে লৌকিক উপাচারে বাঘুতের (বাঘের দেবতা) পুজো করছিলেন সন্তোষ মাহাতো। মহুল গাছের তলায় পোড়া মাটির হাতি-ঘোড়ার ছলনে বাঘ দেবতার উদ্দেশ্যে আতপ চাল-গুড়-দুধ-দুর্বা ঘাসের নৈবেদ্য নিবেদন করে বর্ষীয়ান সন্তোষবাবু জানালেন, বল্লম খুঁচিয়ে বাঘুতকে মেরে ফেলার মতো হীন কাজকে কখনওই সমর্থন করা যায় না।

Advertisement

ঝাড়গ্রামের চুবকা অঞ্চলের ঘোড়াজাগির গ্রামের ‘লায়া’ (লৌকিক পূজারী) সন্তোষবাবুর মতো জঙ্গলমহলের আদিবাসী-মূলবাসীরা বাঘের মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না। সন্তোষবাবু বলেন, “সারা বছর হাতির দল এসে কত ফসল নষ্ট করে। হাতির হানায় প্রতি বছর কত মানুষের মৃত্যু হয়। তা বলে কী আমরা ‘হাতি ঠাকুর’কে মারতে যাই! বাঘুতও তো আমাদের প্রাচীন দেবতা। তাঁকে বাদ দিয়ে গরাম থানের পুজো হয় না। সেই বাঘুতকেই কিছু মানুষ মেরে ফেলল!” বিনপুরের বাঘাশোল গ্রামের প্রবীণ চাষি খগেন মাহাতো বলেন, “এলাকার গ্রামের নাম থেকেই বোঝা যায়, এক সময় এখানে বাঘ ছিল। আমরা বাঘুতকে মানি। তাই বাঘের এই মৃত্যু আমাদের কাছে খুবই বেদনাদায়ক।”

সুন্দরবনের দক্ষিণ রায়ের মতো জঙ্গলমহলেও রয়েছেন ‘বাঘুত’। তবে দক্ষিণরায়ের মতো বাঘুতের কোনও মূর্তি বা অবয়ব নেই। পোড়া মাটির হাতি ঘোড়ার ছলনে গরাম থানে গাছতলায় তাঁর পুজো হয়। জঙ্গলমহলের গ্রামগুলিতে বহু প্রাচীনকাল থেকে বাঘের-দেবতার পুজোর প্রথা চলে আসছে। এখনও কার্তিক মাসে বাঁদনা পরবে গৃহস্থের গোয়াল ঘরে বাঘুতের পুজো হয়। মাঘ মাসের প্রথম দিনে গরাম থানে বাঘ-দেবতার সন্তুষ্টি বিধানের প্রথা চলে আসছে কয়েক শতাব্দী ধরে। এ ছাড়া চৈত্র সংক্রান্তির দিনেও কোনও কোনও গ্রামে বাঘুতের পুজো হয়। কোনও গ্রামে আবার আষাঢ়ে অম্বুবাচীর দিনে পুজো পান বাঘুত। কেন বাঘুতের পুজো করা হয়? বিনপুরের বসন্তপুর গ্রামের গরাম থানের দেহুরি (পূজারি) ৮০ বছরের মন্টু গায়েন বলেন, “গ্রাম দেবতা গরামের সঙ্গে ব্যাঘ্রদেবতার পুজো হয়। বাঘুতের সন্তুষ্টি বিধানের উদ্দেশ্য হল, গৃহস্থের গবাদি গরু ছাগলগুলি যেন জঙ্গলে চারণভূমিতে গিয়ে অক্ষত থাকে। জঙ্গলে গিয়ে বাসিন্দাদেরও যেন কোনও ক্ষতি না হয়। সেই উদ্দেশ্যেই প্রাচীন যুগ থেকে এই অঞ্চলে বাঘুতের পুজো হচ্ছে।” ভারী গলায় মন্টুবাবু বলেন, “এই এলাকায় প্রায় একশো বছর পরে বাঘের আগমন ঘটেছিল। কিন্তু আমরা দেবতাকে রক্ষা করতে পারলাম না।”

Advertisement

ঝাড়গ্রামের লোকসংস্কৃতি গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “জঙ্গলমহলের মূলবাসীদের লোক-বিশ্বাস, বাঘুত জঙ্গলকে রক্ষা করেন। কিন্তু সেই বাঘুতের এমন মর্মান্তিক হত্যার পরে জঙ্গল ও বন্যপ্রাণীদের ভবিষ্যৎ আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ল।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন