Rabindranath Tagore

কথা বলুক সবাই, চাইতেন রবীন্দ্রনাথ

কেমন যেন অরাবীন্দ্রিক বিষয়-আশয়। অশান্তিনিকেতনী!

Advertisement

বিশ্বজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৮ ০১:২২
Share:

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।— ফাইল চিত্র।

অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহ্য করে, তারা দু’জনেই সমান অপরাধী। শাসকেরা যা ইচ্ছে করবে আর সাধারণ মানুষ এটা মেনে চলবে তা হয় না। সহ্যের বাঁধ একসময় যায় ভেঙে। অন্যায় সহ্য না-করার নানা বৃত্তান্ত রবীন্দ্রনাথের নানা নাটকে আছে। এর মধ্যে মুক্তধারা, রক্তকরবী দুই-ই বেশ বিপ্লবধর্মী নাটক। বাঁধ ভেঙে দিচ্ছেন, কারাগারের পাঁচিল লোপাট করে দিচ্ছেন বিপ্লবীরা। আবার অচলায়তন-ই বা কম কী? সে নাটকে একটা ইস্কুলের, আজেবাজে নিয়মের ইস্কুলের, পাঁচিল মিশে যাচ্ছে মাটিতে। এই সব বিপ্লবের মধ্যে ধ্বংসের ও মৃত্যুর নানা রূপ স্পষ্ট, বাস্তব। রবীন্দ্রনাথের শান্তমুখের ছবি দেখে যাঁরা কেবলই ‘প্রশান্ত’ হতে চান এই নাট্য উদাহরণগুলি তাঁদের অনেকেরই কেমন কেমন লাগতে পারে। মার-মার, কাট-কাট, ভাঙাভাঙি— এ আবার কী কাণ্ড! কেমন যেন অরাবীন্দ্রিক বিষয়-আশয়। অশান্তিনিকেতনী!

Advertisement

এই উদাহরণের বিপরীতে তাঁরা রাখতে চাইতে পারেন ‘ঘরে-বাইরে’ ও ‘চারঅধ্যায়’ উপন্যাস। সেখানে আলটপকা বিপ্লবের বিরোধিতা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সহসা উত্তেজিত হয়ে লড়াই-লড়াই খেললেই ফল কিন্তু মিলবে না। পথটি যথার্থ হওয়া চাই। না হলে কাকে মারতে গিয়ে বোমা যে কার মাথায় পড়বে! নিরপরাধের প্রাণ যাবে। এ বিপ্লবের অপচয়, জীবনের অপচয়। রবীন্দ্রনাথ এই অপচয় থেকে তাঁর ইস্কুলকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। তাঁর আশ্রম বিদ্যালয় স্বদেশি রাজনীতির আখড়া হয়ে উঠুক এ মোটেই চাননি তিনি। প্রশ্ন হল, তা হলে ঠিক কী চাইছিলেন রবীন্দ্রনাথ? কী ছিল তাঁর আদর্শ? অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিপ্লব না ধীর-স্থির বিবেচনা? সে বিবেচনার চেহারাই বা কেমন? এমনিতে রবীন্দ্রনাথ অবিবেচক তরুণদের কায়েমি স্বার্থসম্পন্ন বিবেচকদের চাইতে চিরকালই বেশি ভালোবাসতেন। পাকামাথার স্বার্থপরদের দু-চক্ষে দেখতে পারতেন না। সুভাষচন্দ্র তাঁর ছাত্রজীবনে উদ্ধত সাহেব শিক্ষকের অপমান সহ্য করতে না পেরে যখন প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠেছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথ পুরোপুরি সুভাষের পক্ষে। এই ঘটনায় সুভাষের ছাত্রজীবনের ইতি যাতে না হয় সে দিকে কবির গভীর খেয়াল। দেশের বিপ্লবে যে তরুণেরা আত্মাহুতি দিলেন তাঁদের নিঃস্বার্থতা সম্বন্ধে তাঁর শ্রদ্ধার অভাব ছিল না। বীরের রক্তধারা ব্যর্থ হয় না, তা তিনি বিশ্বাস করতেন। তবে স্বার্থহীন তরুণদের তাৎক্ষণিক আবেগের বহিঃপ্রকাশ যে অনেক সময় অপচয়কেই মুখ্য করে তোলে, এটাও মানতেন। তাই হয়তো তাঁর ইস্কুলে বিবেচনা অনুশীলনের নানা পন্থার অনুসন্ধানী ছিলেন তিনি।

বিবেচনা অনুশীলনের প্রথম শর্ত হল নিজের কথা বলতে পারা ও অন্যের কথা শুনতে চাওয়ার মুক্ত পরিসর তৈরি করা। নিজের কথা যেন সবাই বলতে পারে, কথা বলতে পারার অধিকার যেন সকলেরই থাকে। বড়রা আর বুড়োরাই কেবল নিজের কথা বলতে পারবে, ছোটরা তাদের কথা বাধ্য হয়ে শুনবে— এই পন্থার বিরোধী ছিলেন কবি। তাঁর ইস্কুলে শিক্ষকেরা ছেলেদের বিষয়ে ওপর থেকে নাক গলাবেন, এ তিনি মোটে চাইতেন না। তাঁর অভিরুচি, পড়ুয়ারা নিজেরাই নিজেদের কথা বলা ও শোনার মধ্য দিয়ে তাদের নানা সমস্যার সমাধান করবে। এই যে কথা বলা ও শোনার অনুশীলনে রপ্ত হলে বিপ্লবের আচমকা উল্লাসে অপচয়ের মাত্রা কিছু কমবে। বড় ও বুড়োদের কায়েমি বিবেচনার চাইতে পড়ুয়াদের বিবেচনার জগৎটি আলাদা। তারা পূর্ব-নির্ধারিত সূত্র মাথায় নিয়ে যুক্তি সাজাতে বসে না, কথায় কথায় তাদের যুক্তি ওঠে গড়ে। তাদের বিবেচনার অনুশীলনটি জায়মান, টাটকা। বিবেচনার নামে জগদ্দল পাথরের বোঝায় তাদের মন চাপা পড়ে নেই। এই যে-কোনও পরিস্থিতিতে কথায় কথায় বিবেচনার চেহারা তৈরি করার কথা ভাবছেন রবীন্দ্রনাথ, এ আসলে গণতন্ত্রের অনুশীলন। এই গণতন্ত্র কেবল রাষ্ট্রিক নয় ও সামাজিক। রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের চাইতে রবীন্দ্রনাথের এই সামাজিক গণতন্ত্রের ভিত্তি অনেক দৃঢ় বলে মনে হয়। সামাজিক মানুষ প্রতিটি স্তরে যেন কথা বলা ও শোনায় ভরসা রাখতে পারে। রবীন্দ্রনাথের নাটকে মাঝে মাঝেই সাধারণ মানুষের নানা দৃশ্য চোখে পড়ে, তারা কথা বলছে, কেবলই কথা বলছে। সব সময় যে কোনও সিদ্ধান্তে যাওয়া যাচ্ছে তা নয়, কথা যে সব সময় কাজের তা-ও নয়, তবে কথায় কথায় সামাজিকতার একটা চেহারা উঠছে গড়ে।

Advertisement

তখন মঞ্চে চলছে রবীন্দ্রনাথের নাটক রক্তকরবী

রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ নাটকের অমল আর পিসেমশাই। পিসেমশাই যুক্তি সাজান পাকা মাথায়, পূর্ব নির্ধারিত যুক্তির খাঁচা তাঁর মনের জানলা বন্ধ করে দিয়েছে। সমাজের সাধারণের সঙ্গে তাঁর মত মেলে না, পথও মেলে না। আর অমল সবসময় কথা বলছে খোলা মনে। অন্যের কথা শুনছে, নিজের যা মনে হচ্ছে বলছে। এ ভাবে বলতে বলতে তার মনে চারপাশ সম্বন্ধে বোধ তৈরি হচ্ছে, সেই বোধের সঙ্গে পিসেমশাইয়ের বিবেচনা মিলছে না। তাতে ক্ষতি নেই। ডাকঘর বিপ্লবের নাটক নয়, কথার সামাজিকতার নাটক। জানলার ধারে বসে একটা ছেলে কত জনকে ডাকছে, তারা এসে জুটছে। জানলার ধারে যেন মেলা বসে যাচ্ছে। মেলা, কথার মেলা, যোগাযোগের মেলা। মেলাই তো আমাদের কৌম সমাজের প্রাণ। এই কথা জারি রাখা চাই। এই কথার সামাজিকতা বজায় থাকলে অনেক বিপদ যায় মিটে। ইংরেজদের সঙ্গে সামাজিকতা যেখানে ছিল না সেখানেই শাসকে আর শাসিতে চূড়ান্ত দূরত্ব। অচলায়তন, মুক্তধারা, রক্তকরবী— তিন নাটকেই কথা থামানোর চেষ্টা চলে। কথা বলার অধিকার ও শোনার অধিকার বন্ধ করে দেওয়া হয় নানা ভাবে। সামাজিকতা রুদ্ধ হল, তখন বিপ্লব ভেঙে দিল সেই রুদ্ধতা। বিপ্লবের গুরুত্ব কেমন করেই বা অস্বীকার করবেন রবীন্দ্রনাথ! তবু শুধু খেয়াল করিয়ে দেন, এই চূড়ান্ত সংঘাতের আগে আমরা যেন নানা ভাবে কথা বলা ও শোনার সামাজিকতা বজায় রাখার চেষ্টা করি।

এই পোড়া দেশ গণতন্ত্র নিয়ে গর্ব করে। রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে নানা কলুষ এসে জমে। সে অন্যায় অসহনীয়। চূড়ান্ত আঘাত আসবে যদি না কথার সামাজিকতা খুলে দিতে পারে দ্বার। কথার এই সামাজিকতা রাষ্ট্রিক গণতন্ত্রের থেকে প্রবল ও বৃহৎ। রূপটিও দেশজ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন