তাপস-কাণ্ড ‘পুরনো কাসুন্দি’, কুলুপ মহিলা কমিশনের

তর্জন-গর্জনই সার কথা! বর্ষণের ছিটেফোঁটাও দেখা গেল না। তিন দিন আগে টিভি চ্যানেলে তাপস পালের হুঙ্কারের পরে তাঁর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থার আর্জি জানালেও বাস্তবে দেখা গেল, টুঁ শব্দটি করার পথেও হাঁটছে না রাজ্য মহিলা কমিশন। গত মঙ্গলবারই সাংসদ তাপসকে গ্রেফতারের জন্য সওয়াল করেছিল কমিশন। রাজ্য মহিলা কমিশনের সভাপতি সুনন্দা মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, দ্রুত কড়া ব্যবস্থা নিতে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আর্জি জানিয়েছি। তার পরে ৪৮ ঘণ্টা না-কাটতেই সুনন্দাদেবী কার্যত ভোল পাল্টালেন। বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যমের সামনে তাঁর মন্তব্য, “পুরনো কাসুন্দি আর ঘাঁটবেন না!”

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৪ ০৩:০৭
Share:

তর্জন-গর্জনই সার কথা! বর্ষণের ছিটেফোঁটাও দেখা গেল না। তিন দিন আগে টিভি চ্যানেলে তাপস পালের হুঙ্কারের পরে তাঁর বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থার আর্জি জানালেও বাস্তবে দেখা গেল, টুঁ শব্দটি করার পথেও হাঁটছে না রাজ্য মহিলা কমিশন।

Advertisement

গত মঙ্গলবারই সাংসদ তাপসকে গ্রেফতারের জন্য সওয়াল করেছিল কমিশন। রাজ্য মহিলা কমিশনের সভাপতি সুনন্দা মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, দ্রুত কড়া ব্যবস্থা নিতে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আর্জি জানিয়েছি। তার পরে ৪৮ ঘণ্টা না-কাটতেই সুনন্দাদেবী কার্যত ভোল পাল্টালেন। বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যমের সামনে তাঁর মন্তব্য, “পুরনো কাসুন্দি আর ঘাঁটবেন না!”

বাস্তবিক, এ দিন কমিশনের বৈঠকে তাপস-কাণ্ড নিয়েই কোনও কথা হয়নি। এ দিন সেখানে দু’টি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়। দু’টি প্রস্তাবই রেখেছিলেন তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের রাজ্য সভানেত্রী এবং কমিশনের সদ্য নিযুক্ত ভাইস-চেয়ারপার্সন দোলা সেন। দোলা জানান, এ রাজ্যে পঞ্চায়েতে এখন ৫০% আসনই মহিলা সংরক্ষিত। সেই মহিলাদের প্রশাসন ও আইন বিষয়ে ওয়াকিবহাল করতে কমিশন কাজ করবে। মহিলা নির্যাতন বন্ধে জেলা পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে কমিশনের একটা সমন্বয় তৈরি করা দরকার। এই দু’টি প্রস্তাবই অবশ্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুমতি পেলে চূড়ান্ত হবে বলে দোলা জানান।

Advertisement

তবে বিজেপি-র রাজ্য সম্পাদক ঋতেশ তিওয়ারির নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল এ দিন তাপস-কাণ্ডে ব্যবস্থা নিয়ে কমিশনের কাছে দরবার করে। এর বাইরে কমিশনের তরফে ন্যূনতম সাড়া-শব্দ শোনা যায়নি। কেন আলোচনা হয়নি সে বিষয়ে সুনন্দাদেবীও স্পষ্ট ভাবে কিছু জানাতে চাননি। তবে তাপস পাল-প্রসঙ্গ যে কার্যত হিমঘরে ঢুকে গিয়েছে বুঝিয়ে তাঁর বক্তব্য, “এটা নিয়ে আমাদের সদস্যদের মধ্যে আগেই আলোচনা হয়ে গিয়েছে। সেই অনুযায়ীই মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। বৈঠকে নতুন করে আলোচনার কিছু নেই।”

রাজ্যের শাসক দলের এক সাংসদের মুখে ছাপার অযোগ্য হুমকি শোনার পরে সমাজের নানা স্তর থেকেই প্রতিবাদ উঠে এসেছে। এক জন সাংসদের কাছ থেকে এমন উস্কানি বিপজ্জনক সঙ্কেত বলেই তাপসকে সাংসদ পদ থেকে সরানোর দাবি করেছিলেন বিশিষ্টেরাও। তাঁদের মতে, তাপসের স্রেফ দুঃখপ্রকাশেই বিষয়টিতে যবনিকা পড়লে পশ্চিমবঙ্গের বিষয়েই দেশের কাছে চরম অশুভ বার্তা যাবে। দেখা যাচ্ছে, শাসক দল তথা মুখ্যমন্ত্রী চিঠির মাধ্যমে তাপসের ক্ষমা চাওয়ার পরেই বিষয়টি ধামাচাপা দিতে ব্যস্ত। রাজ্য মহিলা কমিশনও যে মুখ্যমন্ত্রীর এই অবস্থানের পর বিষয়টি নিয়ে জলঘোলা করতে চায় না এ দিন সেই সঙ্কেত মিলেছে।

কমিশনের সদস্যদের মধ্যেই টালিগঞ্জ ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত দু’জন অভিনেত্রী আছেন। তাঁরা হলেন, জুন মালিয়া এবং লকেট চট্টোপাধ্যায়। অভিনেতা তথা সাংসদ তাপসের মন্তব্যের তাঁরাও নিন্দা করেছিলেন। বলেছিলেন, কমিশনের বৈঠকে এই নিয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু জুন এ দিন তাপস-প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতে অস্বীকার করেন। আর কমিশনের সদস্য হিসেবে তাঁর প্রথম বৈঠকের অভিজ্ঞতার পরে লকেট বলেছেন, “আজ আমাদের সকলের মধ্যে সৌজন্যমূলক আলাপচারিতাই হয়েছে। হয়তো ১০ জুলাই পরের বৈঠকে তাপসদার বা অন্য বিষয়ে কথা হবে।”

এমনিতে কমিশনের তরফে অবশ্য কারও আচরণের বিরুদ্ধে সরাসরি আইনি ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তা বলে স্রেফ নিন্দা করে হাত গুটিয়ে বসাও তাদের কাজ নয় বলেই মনে করেন সমাজকর্মীরা। অনেকেরই মত, এক্তিয়ারের মধ্যে থেকেই কমিশন আরও কিছু পদক্ষেপ করতে পারে। কী করতে পারে কমিশন?

আইনজীবীদের মতে, মহিলা কমিশন চাইলে প্রশাসনের কাছ থেকে পুরো ঘটনার রিপোর্ট চাইতে পারে। দ্বিতীয়ত, কারও মন্তব্য অসাংবিধানিক বা মহিলাদের সম্মানহানিকর হলে, পুলিশ-প্রশাসন কেন আইনানুগ ব্যবস্থা নিচ্ছে না, তা জানতে চাইতে পারে কমিশন। এমনকী, প্রয়োজনে যে এলাকায় তাপস পাল ওই সব কথা বলেছেন, সেখানে গিয়ে গ্রামবাসীদের কী অবস্থা, কোনও ভয় বা সন্ত্রাসের আবহ আছে কি না, বিশেষত মহিলারা কেমন আছেন, তা দেখতে পারে কমিশন। তৃতীয়ত, সবিস্তার তদন্তের পরে মহিলা কমিশন সরকারকে একটি রিপোর্টও দিতে পারে। রাজ্য মহিলা কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারপার্সন মালিনী ভট্টাচার্যের কথায়, “মহিলা কমিশন অনেক সময়েই সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়েও নানা সুপারিশ করে। অতীতেও এমন অনেক ঘটেছে।”

বাম আমলেও কিছু ক্ষেত্রে কমিশনের ভূমিকায় প্রশ্ন উঠেছে। যেমন, সিঙ্গুরে অনিচ্ছুক কৃষক পরিবারের মহিলাদের উপরে পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে ততটা সক্রিয় হয়নি কমিশন। কিন্তু ধানতলা বা নন্দীগ্রামের ঘটনার পরেও সন্ত্রস্ত মানুষ তথা মহিলাদের পাশে দাঁড়াতে কমিশনের ভূমিকা সদর্থক ছিল বলেই মনে করেন কোনও কোনও সমাজকর্মী। তাঁদেরই মত, মমতার সরকার ক্ষমতায় আসার পরে কমিশনের সক্রিয়তা কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট।

তবে সুনন্দাদেবী এই অভিযোগ মানতে চাননি। এমনকী, চৌমুহা গ্রামে তাপসের হুঙ্কারের পরেও সেখানে যাওয়ার কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। তাঁর বক্তব্য, মহিলাদের মধ্যে আতঙ্কের বাতাবরণ তো রয়েছেই। কিন্তু সেখানে গিয়ে আলাদা ভাবে কথা বলার কিছু নেই। সুনন্দাদেবীর কথায়, “যে যা-ই বলুন না কেন, আমি মনে করি এই পরিস্থিতিতে আমরা যা করছি সেটাই যথেষ্ট। এর বাইরে আর কিছু করার নেই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন