—ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় পাশ হওয়া অপরাজিতা বিল নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজভবনের কাছে কী ব্যাখ্যা চেয়েছে রাষ্ট্রপতি ভবন? এই বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে রাজ্যের প্রশাসনিক মহলে। গত শুক্রবার জানা গিয়েছিল, রাষ্ট্রপতি ভবনে পাঠানো অপরাজিতা বিলটির বিষয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে এবং তার সঙ্গে ব্যাখ্যা চেয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের কাছে ফেরত পাঠানো হয়েছে। রাজভবন সূত্রে জানা গিয়েছে, চলতি সপ্তাহেই বিলটি রাজভবন থেকে ফেরত এসেছে বিধানসভায়। সেখান থেকে বিলটি গিয়েছে নবান্নে। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, নবান্ন থেকে বিলটি পাঠানো হবে আইন দফতরে।
সেই প্রক্রিয়া চলতে চলতেই প্রশাসনিক মহলের একাংশে গুঞ্জন শুরু হয়েছে এই মর্মে যে, কী কারণে এমন একটি বিলে অনুমোদন দেওয়ার বদলে তার ব্যাখ্যা চেয়ে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালের কাছে সেটি পাঠিয়েছেন রাষ্ট্রপতি? যে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে, জানা গিয়েছে তা-ও। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজভবনের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, মহিলাদের উপর অত্যাচার এবং ধর্ষণ করে খুনের ঘটনায় শাস্তি দিতে দেশে একটি আইন রয়েছে। সেই আইন থাকা সত্ত্বেও কেন আবার নতুন আইন তৈরির প্রয়োজন হল?
প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাতে দিল্লির মুনিরকা এলাকা থেকে শুরু করে মহিপালপুর বাইপাস পর্যন্ত চলন্ত বাসের ভিতর বছর তেইশের মেডিক্যালের ছাত্রীকে নৃশংস ভাবে ধর্ষণ করে খুন করা হয়। সেই ঘটনার প্রতিবাদে উত্তাল হয় দেশ। আশঙ্কাজনক অবস্থায় ওই যুবতীকে প্রথমে দিল্লির সফদরজং হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় সিঙ্গাপুরে। ২৯ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে ওই যুবতীর মৃত্যু হয়। ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে রাজধানী দিল্লির রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে সরব হয়েছিল আমজনতা। জনবিক্ষোভ সামাল দিতে সেই সময়ের মনমোহন সিংহ সরকার নতুন আইন তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। ওই আইনটি তৈরির আগে বিচারপতি জেএস বর্মা কমিটি গঠন করা হয়েছিল। যারা মাত্র ২৯ দিনে একটি রিপোর্ট তৈরি করে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জমা দেয়। সেই রিপোর্টে সুপারিশের ভিত্তিতেই সংসদের দুই কক্ষে ‘নির্ভয়া বিল’ (নির্যাতিতাকে সারা দেশে ‘নির্ভয়া’ নামেই পরিচিত করানো হয়েছিল) পাশ করিয়ে নতুন আইন তৈরি হয়েছিল।
সেই আইনের কথা উল্লেখ করেই রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে রাজভবনের কাছে নতুন আইন সম্পর্কে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। গত বছর ৮ অগস্ট গভীর রাতে আরজি কর হাসপাতালে ধর্ষণ করে খুন করা হয় এক চিকিৎসককে। সেই ঘটনার প্রতিবাদে ১৪ অগস্ট বাংলা জুড়ে ‘রাত দখল’ কর্মসূচি হয়। চিকিৎসকদের একাংশ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। সঙ্গে ধারাবাহিক বিক্ষোভ হতে থাকে রাজ্যের প্রায় সব প্রান্তে।
গত বছর ২৮ অগস্ট তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসের মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেন, খুন ও ধর্ষণের ঘটনা রুখতে নতুন আইন আনবে রাজ্য সরকার। সেপ্টেম্বর মাসে রাজ্য সরকারের সুপারিশে বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডাকেন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই অধিবেশনে সেপ্টেম্বর মাসে মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতিতে ‘অপরাজিতা (নারী অধিকার সুরক্ষা) বিল ২০২৫’ বিল পাশ হয়ে যায়। সেই বিলে সায় দিয়েছিল বিরোধী দল বিজেপি-ও। পরে তা অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় রাজ্যপালের কাছে।
সাধারণত রাজ্য বিধানসভায় পাশ হওয়া বিলে রাজ্যপাল স্বাক্ষর করলেই তা আইনে পরিণত হয়। কিন্তু বেশ কিছু ক্ষেত্রে রাজ্যপাল সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের কাছে সেই বিল সংক্রান্ত ব্যাখ্যা চাইতে পারেন। আবার কোনও ক্ষেত্রে রাজ্যপাল যদি মনে করেন, বিলে অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের প্রয়োজন রয়েছে, তখন তিনি সেই বিল পাঠাতে পারেন দিল্লিতে। আরজি কর হাসপাতালের ওই ঘটনা জাতীয় রাজনীতিকেও আন্দোলিত করেছিল। তাই রাজ্যপাল বোস বিলটি অনুমোদনের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর কাছে। সম্প্রতি সেই বিলটি রাষ্ট্রপতি ফেরত পাঠিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের রাজভবনে। আপাতত বিধানসভা ঘুরে বিলটি পৌঁছেছে রাজ্য সরকারের সদর দফতরে।
বিল ফেরত আসার বিষয়টি সম্পর্কে শাসক শিবির অবহিত। বিধানসভায় তৃণমূল পরিষদীয় দলের মুখ্য সচেতক নির্মল ঘোষ বলেন, ‘‘অপরাজিতা বিলটি আমরা পাশ করিয়েছিলাম শুধু পশ্চিমবঙ্গের নারী নির্যাতন বা খুন ধর্ষণের ঘটনা রুখতে নয়। সারা দেশে যাতে নারী নির্যাতনের ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বন্দোবস্ত করা যায়, সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে। শুনলাম ব্যাখ্যা চেয়ে বিলটি ফেরত পাঠানো হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী চেয়েছিলেন নারীদের বিরুদ্ধে অপরাধীদের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়। সেই ভাবনা থেকেই তিনি ওই বিল বিধানসভায় এনেছিলেন। এখন মনে হচ্ছে, নারী নির্যাতন রুখতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। তাই আমাদের সরকারের এমন উদ্যোগকে থামিয়ে দেওয়া হচ্ছে।’’ বিজেপি পরিষদীয় দলের মুখ্যসচেতক শঙ্কর ঘোষ অবশ্য পাল্টা বলেছেন, ‘‘বিল ফেরত আসা নিয়ে বিজেপি-কে দায়ী করার আগে এই রাজ্য সরকারের উচিত জবাব দেওয়া, কেন আরজি কর কাণ্ডের দোষীদের আড়াল করার চেষ্টা হয়েছিল। কসবা ল’কলেজের ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত এবং তাদের প্রশ্রয়দাতাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছেন তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্ব? অপরাজিতা বিলটি পাশ করানোর পরেও এ রাজ্যে অনেক নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। সে ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের ভূমিকা কী ছিল, তা-ও রাজ্যের মানুষ জানতে চাইছেন।’’