Bogtui

বগটুইয়ের হিংসায় ছেদ পড়বে কবে

ট্রাক থেকে তোলার ভাগ ভাদুর কাছে যেত বলে বারবার অভিযোগ উঠেছে। বীরভূমে দীর্ঘদিন কাজ করে যাওয়া এক পুলিশ আধিকারিকের মতে, ১৪ নম্বর জাতীয় সড়কের একেবারে ধার ঘেঁষা বগটুই।

Advertisement

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায় 

রামপুরহাট  শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২২ ০৬:৩২
Share:

ভাদু শেখ এবং লালন শেখ। ফাইল চিত্র।

গ্রামে নেই কোনও পাথর বা কয়লা খাদান। বালিঘাটও নেই। অথচ রামপুরহাট শহর ঘেঁষা সেই বগটুই গ্রাম কেন বারবার হানাহানি-হিংসায় জ্বলে? কেন সেখানে ভাদু শেখ বা লালন শেখদের মতো ‘প্রভাবশালীর’ উত্থান হয়? কেন পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে খুন করা হয় ১০ জনকে?

Advertisement

বগটুইয়ে আগেও মারধর, বোমাবাজি, খুনের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি, বোমা বাঁধতে গিয়ে সাত জনের মৃত্যু হয়েছিল এই গ্রামেই। মূলত, তোলা আদায় এবং তার বখরা ঘিরে দ্বন্দ্বের জেরেই বগটুইয়ে বারবার হিংসা হয় বলে অভিযোগ। স্থানীয় বড়শাল গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান, তৃণমূল নেতা ভাদু শেখ বগটুই ও সংলগ্ন এলাকায় একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। বগটুইয়ে কার্যত ভাদুই ছিলেন ‘শেষ কথা’। কিন্তু, এলাকায় একাধিপত্য কায়েম রাখতে গেলে প্রয়োজন রাজনৈতিক আশ্রয়ের, টাকার এবং অবশ্যই লোকবলের। অভিযোগ, লালনের মতো অনেকে সেই ‘বাহুবলীর’ কাজটাই করতেন। ভাদুকে ঘিরে অধিকাংশ সময় ৮-১০ জনের ‘বাহিনী’ থাকত। সেই ‘বাহিনী’ পুষে রাখার জন্য অর্থের জোগান দিত ‘তোলা আদায়’। এই ‘তোলাবাজি’ বগটুইয়ের হিংসা-হানাহানির মূল কারণ বলে অভিযোগ।

ট্রাক থেকে তোলার ভাগ ভাদুর কাছে যেত বলে বারবার অভিযোগ উঠেছে। বীরভূমে দীর্ঘদিন কাজ করে যাওয়া এক পুলিশ আধিকারিকের মতে, ১৪ নম্বর জাতীয় সড়কের একেবারে ধার ঘেঁষা বগটুই। সহজেই তা বালি-পাথর কারবার থেকে টাকা তোলার অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল। বগটুই মোড়ের উপর দিয়ে যাওয়া বালি-পাথরের ট্রাক থেকে টাকা আদায়ের কারবার চলত বলে জানাচ্ছেন স্থানীয়দেরও একাংশ। ২১ মার্চ রাতে বোমা মেরে ভাদু শেখকে খুন এবং ঠিক তার পরেই ‘বদলার রোষে’ বহটুইয়ে ভাদু-বিরোধী বলে পরিচিত পরিবারগুলির ১০ সদস্যকে হত্যার পিছনে এই বালি-পাথরের টাকার ‘বখরার’ দখল নেওয়ার বিষয়টির বড় ভূমিকা রয়েছে বলে তদন্তে জানতে পেরেছে সিবিআই-ও। ভাদু-খুনের পরে তাঁর বাবাও বলেছিলেন, ‘‘বখরার জন্যই খুন করা হয়েছে ভাদুকে। যারা বখরা পায়নি, তারাই ওকে মেরেছে!’’

Advertisement

স্থানীয়দের একাংশের দাবি, বাম জমানার শেষের দিকে এবং পালাবদলের পরে বগটুই গ্রামের কয়েক জন ‘বাহুবলীকে’ কাজে লাগিয়ে রামপুরহাট শহর এবং রামপুরহাট থানা এলাকায় প্রভাব খাটাতেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। কলেজে ছাত্র সংসদের নির্বাচন, স্কুল পরিচালন সমিতি কিংবা সমবায় সমিতির নির্বাচনে ওই সমস্ত বাহুবলীকে রাজনৈতিক নেতারা ব্যবহার করেছেন বলে বরাবর দাবি। এমনকি রামপুরহাট প্রধান বাসস্ট্যান্ড এলাকায় দখলদারি থেকে হাসপাতাল, নার্সিংহোমে চিকিৎসার গাফিলতিতে রোগী মৃত্যু ঘটনায় ভাঙচুরের ঘটনাতেও বারবার বগটুইয়ের নাম জড়িয়েছে। একটা সময় সুদের কারবার, ছাগলের পাইকারি কারবার, জমির দালালি— এ সব থেকেই কাঁচা টাকার আমদানি হত বগটুইয়ে। ভাদু শেখের উত্থানের পর থেকে ‘তোলা আদায়’ এক প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা পায় বলে বিভিন্ন মহলের অভিযোগ। পাথর-বালির ট্রাক থেকে তোলা আদায় তখন কাঁচা টাকা আয়ের প্রধান পথ হয়ে দাঁড়ায়।

পালাবদলের আগে অবধি বগটুই গ্রামে বামেদের বেশি দাপট ছিল। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে গ্রামে তৃণমূল প্রভাব ফেলতে শুরু করে। ভাদু শেখের স্ত্রী তৃণমূল প্রার্থী হন। তখন ভাদু ও তাঁর দাদা বাবরকে পরিবার নিয়ে গ্রাম ছাড়তে হয়েছিল। দু’বছর তাঁরা গ্রামছাড়া ছিলেন। অভিযোগ, এর পরে রামপুরহাটের শীর্ষ তৃণমূল নেতাদের একাংশের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন ভাদু। সেই থেকে তাঁর উত্থান। এবং তাঁর হাত ধরে প্রভাব বিস্তার লালন শেখদের।

আজ ভাদু নিহত। সিবিআই হেফাজতে মৃত্যু হয়েছে লালনের। কিন্তু, বগটুইয়ে কি থামবে হানাহানির ঐতিহ্য? স্থানীয় বাসিন্দার একাংশের মতে, বগটুই গ্রামে ‘বাহুবলী’দের দাপট থামাতে না-পারলে বখরার লড়াইও থামবে না। ছেদ পড়বে না রক্ত ঝরার সংস্কৃতিতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন