ওষুধের দাম বেঁধে দেওয়ার দায়িত্ব কি অন্য বিভাগে

ওষুধের দাম কমানোর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারক সংস্থা ‘ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি’ (এনপিপিএ)-র ডানা কি ছাঁটতে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকার?

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:০৫
Share:

ওষুধের দাম কমানোর ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারক সংস্থা ‘ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি’ (এনপিপিএ)-র ডানা কি ছাঁটতে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকার? কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক, সার ও রসায়ন মন্ত্রক এবং নীতি আয়োগের সাম্প্রতিক বৈঠকের পরে তীব্র হয়েছে এই জল্পনা। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রে খবর, প্রাথমিক ভাবে ওই বৈঠকে ওষুধের দাম কমানোর ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত সার ও রসায়ন মন্ত্রকের অধীন ফার্মাসিউটিক্যাল বিভাগের হাতে তুলে দেওয়ার কথা ভাবা হয়েছে। এমনটা হলে দেশে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের দাম ফের বাড়তে পারে বলে বিভিন্ন মহলের আশঙ্কা।

Advertisement

১৯৯৭ সাল থেকে দেশে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব রয়েছে স্বশাসিত সংস্থা এনপিপিএ-র হাতে। দেশে কোথায় কোন ওষুধের সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে, কী ভাবে সেই সমস্যার সমাধান হয় এবং কী ভাবে ওষুধের দামকে মানুষের নাগালের মধ্যে রাখা যায় সেই সংক্রান্ত নীতি-নির্ধারণের দায়িত্ব তাদেরই। গত দু’তিন বছরে ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, হাইপার টেনশন-সহ বিভিন্ন ওষুধের দাম কমানোর সিদ্ধান্ত তারাই নিয়েছে। সে নিয়ে একাধিক বার কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগের সঙ্গে বিরোধেও জড়িয়ে পড়েছে এনপিপিএ। কিন্তু এ বার স্টেন্ট-এর দাম কমানোর ক্ষেত্রে তাদের অনড় মনোভাব বহু দফতরকেই অস্বস্তিতে ফেলেছে বলে এনপিপিএ কর্তাদের অভিযোগ। তাঁদের ধারণা, সেই কারণেই ওষুধের দাম কমানোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ফার্মাসিউটিক্যাল বিভাগের হাতে দেওয়ার কথা ভাবা হয়েছে।

কেন্দ্রীয় সার ও রসায়ন মন্ত্রী অনন্ত কুমার অবশ্য বিষয়টি স্বীকার করেননি। তিনি বলেন, ‘‘ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণের কাজটা এনপিপিএ-ই করবে। আর স্টেন্টের ব্যাপারে তো ইতিমধ্যেই আমরা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করতে বলে দিয়েছি।’’ তবে ওই বৈঠকের ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে চাননি তিনি।

Advertisement

কেন মনে করা হচ্ছে যে ফার্মাসিউটিক্যাল দফতরের হাতে ক্ষমতা গেলে ওষুধের দাম বাড়বে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তার কারণ সার ও রসায়ন দফতর একাধিক বার সরকারি ভাবে জানিয়েছে, দাম নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে প্রতিযোগিতার বাজারকে সঙ্কুচিত করা হচ্ছে। ফার্মা সেক্টরে বিনিয়োগ কম হচ্ছে। গবেষণার দিকগুলিও ধাক্কা খাচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ড্রাগ কন্ট্রোলের এক কর্তা বলেন, ‘‘গত মার্চে প্রয়োজনীয় ওষুধের দাম এক ধাক্কায় অনেকটা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এনপিপিএ। সেই অনুযায়ী সংগঠনগুলিকে নির্দেশও দেওয়া হয়। কিন্তু ওষুধ সংস্থাগুলির যৌথ মঞ্চ ‘ইন্ডিয়ান ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যালায়েন্স’ এ নিয়ে ফার্মাসিউটিক্যাল বিভাগের কাছে অভিযোগ জানায়। মাস কয়েকের টালবাহানার পর এনপিপিএ-র আগের নির্দেশের ওপর লাগাম পরায় ফার্মাসিউটিক্যাল বিভাগ। বলা হয়, এমনিই বিক্রয়মূল্যের চেয়ে বহু ক্ষেত্রে কম দাম নিচ্ছে সংস্থাগুলি। এর পরেও দাম কমাতে বললে ওষুধের মানের সঙ্গে আপস করা হবে। ওষুধ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কমবে।

এই নির্দেশে জোর বিতর্ক শুরু হয় চিকিৎসক মহলে। সেই রেশ কাটতে না কাটতেই সরকারের এই সিদ্ধান্তে অশনি সঙ্কেত দেখছেন অনেকেই। এনপিপিএ-র চেয়ারম্যান ভূপেন্দ্র সিংহ অবশ্য মুখ খুলতে চাননি। তিনি শুধু বলেছেন, ‘‘এত বড় একটা সিদ্ধান্ত সরকার রাতারাতি নিতে পারে না। আরও অনেক আলোচনা দরকার। আমরা আশা করি সরকার এমন কিছু করবে না যার জন্য গরিব মানুষ বিপদে পড়বেন।’’

এনপিপিএ সদস্যদের মনোনীত করে কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রীয় সরকারের সচিব পর্যায়ের এক জন আইএএস অফিসারকে চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ করা হয়। যাঁদের সদস্য হিসেবে বেছে নেওয়া হয়, তাঁদের ক্ষেত্রে ফার্মাসিউটিক্যাল, অর্থনীতি এবং কস্ট অ্যাকাউন্ট্যান্সি-র ক্ষেত্রে কাজের অভিজ্ঞতা আবশ্যিক। সরকারের যুগ্মসচিব পদমর্যাদার অফিসারকে মেম্বার সেক্রেটারি হিসেবে নিয়োগ করা হয়। বর্তমান চেয়ারম্যান তাঁর দায়িত্ব নিয়েছেন বছরখানেক আগে।

ওষুধের দাম নিয়ে বিতর্ক, অভিযোগ রয়েছে কমবেশি প্রায় সব দেশেই। যদিও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন জায়গাতেই ‘ভ্যালু বেসড প্রাইস’ চালু রয়েছে। দামের ক্ষেত্রে প্রস্তুতকারক সংস্থাকে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ সরবরাহ করতে হয়। স্পেনে ‘হেলথ টেকনোলজি অ্যাসেসমেন্ট’-এর ব্যবস্থা রয়েছে। মন্ত্রীরা ওষুধ প্রস্তুতকারকদের ডেকে ওষুধের ন্যায্য দাম নির্ণয় করেন। অস্ট্রেলিয়াতেও ওষুধ সংস্থাগুলিকে ওষুধের গুণমান প্রমাণ করে সেই অনুযায়ী কোন দামটা ন্যায্য, তা স্থির করতে হয়। চিনে ন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট অ্যান্ড রিফর্ম কমিশন ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করে। আমদানি করা ওষুধের তুলনায় দেশি ওষুধের দাম সেখানে অনেক কম।

এ দেশে ওষুধ আন্দোলনকারীদের একটা বড় অংশের বক্তব্য, ওষুধ তৈরিতে ১ টাকা খরচ করে তার দাম ৫০ টাকা করার মতো ‘অন্যায়’-এর নজির ভারতেই বেশি। আমদানি করা ওষুধের ক্ষেত্রেও কার্যত কোনও লাগাম নেই। সে জন্যই চিকিৎসক মহলের বড় অংশ মনে করছেন, এনপিপিএ-র কাজকর্ম বহু মানুষের কায়েমি স্বার্থে আঘাত করেছে। স্টেন্ট-এর দাম অর্ধেকেরও বেশি কমানোর চেষ্টা সফল হলে সেই স্বার্থ আরও বিঘ্নিত হবে। এ রাজ্যে ওষুধ সংক্রান্ত আন্দোলনের পুরোধা পীযূষ সরকার বলেন, ‘‘ফার্মাসিউটিক্যাল বিভাগ বহু দিন ধরেই খবরদারি শুরু করেছে। পেসমেকার নিয়ে যে জোচ্চুরি চলছিল, তা স্টেন্ট-এও শুরু হয়েছে। সেটা সামনে এলে অনেকের অসুবিধা।’’ একই মত ফার্মাকোলজির অধ্যাপক স্বপন জানারও।

মোদী সরকারের ওষুধ নীতি নিয়ে বহু দিন আগে থেকেই সমালোচনা করে আসছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। একাধিকবা র তিনি অভিযোগ করেছেন, জনবিরোধী ওষুধ নীতির জন্য বহু মানুষ চিকিৎসার সুযোগ পাচ্ছেন না। এ রাজ্যে সেই কারণেই ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকানের সংখ্যা
বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছেন তিনি। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা জানান, সম্প্রতি ফার্মাসিউটিক্যাল বিভাগ এনপিপিএ-কে দাম কমানোর সিদ্ধান্তে লাগাম পরাতে বলার পর মুখ্যমন্ত্রী গোটা বিষয়ের উপর নজর রাখতে বলেছেন। এই নিয়ে দিল্লিতে যা যা ঘটবে নিয়মিত তাঁকে জানাতে বলেছেন। এনপিপিএ-র ডানা ছাঁটার সিদ্ধান্ত সরকারি ভাবে ঘোষণা হলে মমতা আন্দোলনে নামবেন বলেও স্বাস্থ্যকর্তাদের জানিয়ে রেখেছেন বলে ওই কর্তা জানান।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন