ক্যানসার আক্রান্ত মায়ের প্রথম দফার চিকিৎসার খরচ ছেলে পেয়েছিলেন স্বাস্থ্য বিমা থেকে। মাস কয়েক পরে ফের মায়ের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটল। ভিন্ রাজ্যে অন্য এক চিকিৎসকের কাছে মাকে নিয়ে গেলেন তিনি। সেই চিকিৎসক মায়ের আগের রিপোর্ট দেখতে চাওয়ায় তিনি ফাইল থেকে বার করে দিলেন অজস্র রিপোর্টের ফোটোকপি। আসল রিপোর্ট কোথায়? জানা গেল, সমস্ত আসল রিপোর্ট এবং প্লেটই জমা নিয়েছে স্বাস্থ্য বিমা সংস্থা। চিকিৎসক জানালেন, আসল রিপোর্ট না দেখলে তাঁর পক্ষে চিকিৎসা করা সম্ভব নয়।
কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এমন ঘটছে আকছার। ফি বছর মোটা অঙ্কের প্রিমিয়াম দিয়েও চিকিৎসার আসল নথি নিজের কাছে রাখতে পারেন না গ্রাহকেরা। এ নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকে বহু অভিযোগ জমা পড়েছে। এ বার এমনই এক বিমা সংস্থার বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে দলবদ্ধ ভাবে অভিযোগ জমা দিলেন কয়েক জন গ্রাহক। তাঁদের বক্তব্য, এটা গ্রাহক হিসেবে তাঁদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা। যেটা কোনও ভাবেই সংস্থাগুলি করতে পারে না। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ দাবি করেছেন তাঁরা। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রে খবর, আগামী মাসেই বিমা সংস্থাগুলির সঙ্গে বসবেন স্বাস্থ্যকর্তারা। ‘ইনসিওরেন্স ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড রেগুলেটরি অথরিটি’-কেও জানানো হয়েছে।
চিকিৎসক মহলের বক্তব্য, স্বাস্থ্য বিমা বা মেডিক্লেম এখন সমস্ত স্তরের মানুষের চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়ার অন্যতম পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেডিক্লেম ছাড়া ব্যয়বহুল চিকিৎসার কথা ভাবতেই পারেন না অধিকাংশ মানুষ। মেডিক্লেম সংস্থাগুলির ব্যবসা এতে যেমন ফুলেফেঁপে উঠেছে, তেমনই সংস্থাগুলির গা জোয়ারিও বাড়ছে। ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রিপোর্টের ফোটোকপি যে কোনও সময়ে জাল করা যায়। তা ছাড়া চিকিৎসকের পক্ষেও এমন ফোটোকপি দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। বহু চিকিৎসক তো আসল রিপোর্ট না থাকলে গুরুতর অবস্থার রোগীকে দেখে মতামত দিতেই চান না। অনেকের ক্ষেত্রে ফের সেই এক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে হয়, যার কোনও প্রয়োজনই নেই।’’
মেডিসিনের চিকিৎসক অলকেশ সরকারও বলেন, ‘‘কোলোনোস্কোপির রিপোর্টের ফোটোকপি দেখে বহু সময়ে কিছুই বোঝা যায় না। কী ভাবে তার ভিত্তিতে চিকিৎসা করব? আর এই সব পরীক্ষা তো কোনও রোগীকে বারবার করতে বলা যায় না। এমন সমস্যার আমরা আকছার মুখোমুখি হচ্ছি।’’
কী বলছেন রোগী বা তাঁদের পরিবারের লোকেরা? এক রোগিণীর ছেলে অয়ন চৌধুরী বলেন, ‘‘একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থার গ্রাহক আমি। আমার মায়ের ক্যানসার। তাঁর চিকিৎসার জন্য সমস্ত ‘অরিজিনাল’ রিপোর্ট এবং প্লেট বিমা সংস্থা দাবি করেছে। এ ক্ষেত্রে গ্রাহকেরা তা দিতে বাধ্য। কারণ না দিলে চিকিৎসার খরচটা মিলবে না। অথচ চিকিৎসার সব কাগজপত্র নিজের কাছে রাখাটা এক জন রোগীর অধিকার। বিমা সংস্থা তো দাতব্য করছে না। গ্রাহক প্রিমিয়াম দিচ্ছেন বলেই তারা চিকিৎসার খরচ দিচ্ছে। তা হলে এই জবরদস্তি কেন?’’
বিমা সংস্থাগুলির দাবি, তাদের এ ছাড়া উপায় নেই। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত বিমা সংস্থার পূর্বাঞ্চলের এক কর্তা বলেন, ‘‘বহু ক্ষেত্রে একই রোগী একই চিকিৎসার জন্য দু’টি সংস্থার কাছ থেকে টাকা আদায় করেন। আবার ভুয়ো রিপোর্ট জমা দেওয়ার নজিরও অজস্র। এ ক্ষেত্রে আমাদেরও তো একটা বর্ম দরকার। তাই এই ব্যবস্থা চালু রাখতে হয়েছে।’’ একই বক্তব্য বেসরকারি বিমা সংস্থারও। তবে কি এক জন রোগীর চিকিৎসার জন্য দু’টি বিমা সংস্থা থেকে টাকা নেওয়া যায় না, প্রশ্ন উঠছে তা নিয়ে। বিমা সংস্থার কর্তাদের ব্যাখ্যা, কোনও কোনও ক্ষেত্রে একই রোগীর চিকিৎসার খরচের দু’টি অংশ দু’জায়গা থেকে নেওয়া যায়। কিন্তু এক রিপোর্ট দেখিয়ে, সে খাতেই দু’জায়গা থেকে গোটা খরচ তোলা যায় না। তা ঠেকাতেই আসল রিপোর্ট জমার ব্যবস্থা। কিন্তু প্রশ্ন, নিজেদের সুরক্ষার জন্য সংস্থাগুলি যে পন্থা বার করেছে তাতে তো আখেরে ভোগান্তি বাড়ছে গ্রাহকদেরই। তাঁদের জন্যও তো কোনও একটা বর্ম থাকা দরকার। এ রাজ্যেও ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে ইদানীং বিমা সংস্থার দ্বারা এমন ‘হয়রানি’র বহু অভিযোগ জমা পড়েছে। আইনজীবী প্রবীর বসু বলেন, ‘‘কোনও ভাবেই আসল নথি সংস্থাগুলির রেখে দেওয়ার কথা নয়। এ নিয়ে যত দিন না সরকারি স্তরে কোনও সিদ্ধান্ত হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত রোগীরা যে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা বা অস্ত্রোপচার করাচ্ছেন, সেখানে গোড়াতেই আবেদন করে রাখতে পারেন যে তাঁর সমস্ত রিপোর্টের দু’টি করে সেট দরকার। এটা হাসপাতাল দিতে বাধ্য।’’ ইএনটি চিকিৎসক দীপঙ্কর দত্ত বলেন, ‘‘যদি পরবর্তী সময়ে রোগীর আগের ওই রিপোর্টগুলি প্রয়োজন হয়, তা হলে মেডিক্লেম সংস্থার কাছে আবেদন করলে তারা তা ফেরত দিতে বাধ্য। তা ছাড়া, পাওনা মেটানোর জন্য বিষয়টি খতিয়ে দেখতে লিখিত রিপোর্ট প্রয়োজন হতে পারে, প্লেটগুলি কোনও কাজেই লাগার কথা নয়।’’