ফাইলেই আটকে বন্যপ্রাণীর ভবিষ্যৎ

খাবারে টান পড়েছে। আস্তানাও কখনও পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার কখনও লাঠিসোটা, বল্লম-বন্দুক নিয়ে হামলা করে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে গোপন ডেরা। তাতেই জাঁতাকলে পড়ে কখনও মেহগনি গাছের মগডালে আশ্রয় নিচ্ছে চিতাবাঘ। আবার কখনও লাফাতে গিয়ে কুয়োয় পড়ে যাচ্ছে। কখনও সামনে পাওয়া বনকর্মী, গ্রামবাসীদের আঁচড়ে-কামড়ে রক্ত ঝরিয়ে নিজেও রক্তাক্ত হয়ে পড়ছে উত্তরের বনাঞ্চলের চিতাবাঘ।

Advertisement

কিশোর সাহা

শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ০৩ মার্চ ২০১৬ ০১:৫৪
Share:

গাছের উপরে দূরে বসে আছে সন্ত্রস্ত চিতাবাঘ। নীচে তাকে ঘিরে মানুষের ভিড়। —নিজস্ব চিত্র।

খাবারে টান পড়েছে। আস্তানাও কখনও পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার কখনও লাঠিসোটা, বল্লম-বন্দুক নিয়ে হামলা করে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে গোপন ডেরা। তাতেই জাঁতাকলে পড়ে কখনও মেহগনি গাছের মগডালে আশ্রয় নিচ্ছে চিতাবাঘ। আবার কখনও লাফাতে গিয়ে কুয়োয় পড়ে যাচ্ছে। কখনও সামনে পাওয়া বনকর্মী, গ্রামবাসীদের আঁচড়ে-কামড়ে রক্ত ঝরিয়ে নিজেও রক্তাক্ত হয়ে পড়ছে উত্তরের বনাঞ্চলের চিতাবাঘ। চোরাগোপ্তা শিকারও চলছে বলে অভিযোগ। বুধবার ধূপগুড়ির ঘটনার পরে বন অফিসারদের কাছ থেকে বিশদে রিপোর্ট তলব করেছেন বনমন্ত্রী বিনয় বর্মনও। কলকাতার অরণ্য ভবন থেকেও মানুষ-বন্যপ্রাণ সংঘাত রুখতে আরও কী কী করণীয় তার রূপরেখা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের বন্যপ্রাণ বিষয়ক সরকারি উপদেষ্টা পর্ষদের সদস্যদের অনেকেই কাজের কাজ কতটা হবে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। বনমন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, ‘‘সদিচ্ছা রয়েছে বলেই বন দফতরে নানা কাজে হয়েছে ও হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, হাতি-চিতাবাঘ-বাইসন উত্তরের লোকালয়ে ঢুকেই থাকে। তা রুখতে নির্দিষ্ট কিছু ব্যবস্থা রয়েছে। আগামী দিনে সেই ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করা হবে।’’ বন দফতরের এক শীর্ষ কর্তা অবশ্য একান্তে জানান, বেশ কয়েকটি ফাইল লাল ফিতের ফাঁসে আটকে থাকায় কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। নানা সময়ে পরিবেশপ্রেমীদের পক্ষ থেকে দেওয়া অনেক প্রস্তাবও এখন অরণ্য ভবন বা নবান্নের নানা স্তরে আটকে পড়ে। কী আছে সেই প্রকল্প-প্রস্তাবে তা একঝলকে দেখে নেওয়া যাক।

Advertisement

চিতাবাঘ গণনা

Advertisement

উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চলের আদি বাসিন্দা হল চিতাবাঘ। তার সংখ্যা এখন ঠিক কত, কোন কোন এলাকা তার বিচরণ ক্ষেত্র, সে ব্যাপারে স্পষ্ট তথ্য নেই। একটি পূর্ণবয়স্ক চিতাবাঘ দৈনিক গড়ে ৬-৭ কেজি মাংস খায়। বিচরণ ক্ষেত্রে চিতাবাঘের খাদ্য তালিকায় থাকা বন্যপ্রাণের সংখ্যা আনুপাতিক হারে থাকছে কি না, সেটাও অস্পষ্ট। সে জন্য বিচরণ ক্ষেত্রে হরিণ, বন শুয়োরের সংখ্যা বৃদ্ধির পরিকল্পনাও নেওয়া দরকার। না হলে চিতাবাঘের যে খাবারের টানে চা বাগানের ঝোপে, নালায়, কালর্ভাটের নীচে ডেরা করে ক্রমাগত হাঁস-মুরগি-শুয়োর, ছাগল-বাছুর শিকারের প্রবণতা বাড়বে, তা নিয়ে সন্দেহ নেই বনকর্মীদের। সে জন্য চিতাবাঘ বিষয়ক একটা সমীক্ষা, গণনা দরকার। সেই কাজে সরকারি তরফে এখনও সবুজ সঙ্কেত মেলেনি।

রাখাল ও আগুন

সাধারণত সেপ্টেম্বরের শেষার্ধে উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চলে সুখা মরসুম শুরু হয়ে যায়। ৫-৬ মাস বৃষ্টি না হওয়ায় ফেব্রুয়ারির গোড়া থেকে বন শুকনো খটখটে হয়ে থাকে। কোথাও একটা দেশলাই জ্বাললে কিংবা বিড়ি-সিগারেটের ফুলকি থেকেই আগুন ধরে যেতে পারে। আবার বনাঞ্চলের নানা জায়গায় গবাদি পশু নিয়ে রোজই যাতায়াত করে গোপালকরা। তারাও মার্চের গোড়ায় অনেক সময়ে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে দেখেছেন বনকর্মীরা। কেন? কয়েকজন রাখাল জানিয়েছেন, আগুন ধরিয়ে দিলে আগাছা সব পুড়ে যায়। তাড়াতাড়ি সবুজ ঘাস জন্মায়। মার্চের মধ্যে কয়েক দিন বৃষ্টি হলে তা তরতরিয়ে বাড়ে। ফলে, গবাদি পশুর খাবারের সংস্থা কয়েক গুণ বেশি হয়। এটা বন্ধ করতে নজরদারি বাড়ানো দরকার। সে জন্য উত্তরবঙ্গের বনাঞ্চলে নিচু তলায় আরও অন্তত ২০ হাজার কর্মী নিয়োগ জরুরি। সেই নিয়োগের অনুমতি এখনও মেলেনি।

গোয়েন্দা এবং গাইড

পরিবেশপ্রেমী সংস্থাগুলির তরফে দেওয়া প্রস্তাব অনুযায়ী, পাহাড় থেকে সমতল, সব জায়গায় জঙ্গলে নিরাপদে ঘোরানোর জন্য ‘গাইড’ রয়েছেন। তাঁদের নানা স্তরে নিয়মিত ট্রেনিংও দেওয়া হয়। গাইডরা তো বটেই, সাফারির গাড়ির চালক, খালাসিরাও জঙ্গলের নানা সুলুকসন্ধান জানেন। চোরাশিকারি, সন্দেহভাজনদের গতিবিধি, বন্যপ্রাণ কোথায়, কী দেখা গেল, তার অনেক হদিস পান তাঁরা। নিয়মিত সে সব তথ্য বন দফতরকে তাঁরা যাতে জানান, সেই প্রক্রিয়া শুরু হোক। কিন্তু, সরকারি তরফে চিন্তাভাবনা এগোচ্ছে না।

ট্রেজারি গেরো

ডিএফও পদমর্যাদার অফিসাররা আগে জরুরি ভিত্তিতে নিজেরাই অর্থ প্রয়োজন মতো টাকা খরচ করতে পারতেন। এখন ট্রেজারির মারফতেই তা করতে হয়। ফলে, জরুরি প্রয়োজনে কোথাও হাতি তাড়াতে, চিতাবাঘ খাঁচাবন্দি করতে কিংবা দাবানল রুখতে হঠাৎ করে হাজিরা ভিত্তিক কর্মী নিয়োগেও জটিলতা তৈরি হয়। হাজিরা বাবদ টাকা দিতে গেলে তা ট্রেজারির মাধ্যমে অনুমোদিত হওয়া বাধ্যতামূলক। ট্রেজারি বিধিতে রদবদলের আর্জির ফাইলও ধুলোয় চাপা পড়েছে।

কুসংস্কারের তাড়া

চিতাবাঘ, হাতি, বাইসন লোকালয়ে ঢুকে পড়লেও পালানোর রাস্তা পেলে সে দিকেই ছোটে। এটা বোঝাতে লাগাতার প্রচার দরকার। বন্যপ্রাণের জীবনযাপন, ব্যবহার, খাবারের অভ্যেস বিষয়ে সকলের স্পষ্ট ধারণা থাকা দরকার। তা নিয়ে স্কুলে-পাড়ায়, ক্লাবে প্রচারে জোর দেওয়ার পক্ষে পরিবেশপ্রেমীরা। সেটা হচ্ছে না। কিন্তু, হাতির লেজের লোম দিয়ে মাদুলি বানানো, চিতাবাঘের দাঁত, জিভ শুকিয়ে কী হতে পারে, সে সব কুসংস্কার নিয়ে অপপ্রচার মারাত্মক পরিমাণে চলছে। চোরাশিকারি চক্রের সঙ্গে যুক্তরা শহরে-গ্রামে অপপ্রচার চালিয়ে ফায়দা তুলছে। সরকারি তরফে প্রচারের জন্য আরও উদ্যোগ জরুরি বলে পরিকল্পনা পেশ হয়েছে। কাজটা হচ্ছে না।

ঢিলেঢালা মনোভাব

ঘটনা হল, এমন অন্তত শতাধিক প্রস্তাব সম্বলিত ফাইল অরণ্যভবন, নবান্নে গিয়েছে। সরকারি সূত্রের খবর, বাম আমল থেকে তৃণমূল জমানা পর্যন্ত অর্ধেকের বেশি ফাইল আটকে গিয়েছে। কখনও স্রেফ ঢিলেঢালা মনোভাবের জেরে হাতি-চিতাবাঘের বিচরণ ক্ষেত্র বাড়ানোর কাজ থমকে গিয়েছে। কোথাও আবার গণ্ডারের জন্য নতুন বাসভূমি তৈরির কাজও অর্ধেক হয়ে এগোয়নি। অথচ, প্রায় ১০০ কোটি টাকা খরচ করে সাফারি পার্ক তৈরি করে তা চালু হয়ে গিয়েছে। বনাঞ্চলের মধ্যে গজলডোবায় মেগা ট্যুরিজম হাব তৈরির জন্য শতাধিক কোটি টাকার পরিকাঠামো হয়েছে। বিশাল ‘উত্তরকন্যা’ তৈরি হয়েছে। কিন্তু, উত্তরের বন্যপ্রাণকে স্বাভাবিক জীবনযাপনের ব্যবস্থা করে দিতে সরকারি তরফে কোনও আগ্রহই দেখা যাচ্ছে না বলে পরিবেশপ্রেমীদের অভিযোগ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন