TMC

এখন বিজেপির কাছ থেকেও আমরা গণতন্ত্র শিখব?

আমার প্রথম প্রশ্ন হল, বাংলায় গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, এই রকম মন্তব্য করার কোন অধিকারটা বিজেপির রয়েছে?

Advertisement

সৌগত রায়

শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২০ ১১:৪৬
Share:

সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে মানুষের অধিকার রক্ষার আন্দোলনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

এমনিতে দিলীপ ঘোষের কোনও মন্তব্যকেই আমি খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে নিই না। কিন্তু বিজেপির মতো একটা দলের কোনও নেতা যদি পশ্চিমবঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক পরিবেশ সম্পর্কে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শোনাতে থাকেন, তা হলে কিছু কথার জবাব তো দিতেই হয়। সুতরাং এ রাজ্যে গণতন্ত্র ধ্বংসের বিলাপ করতে করতে আনন্দবাজার ডিজিটালে দিলীপ ঘোষ যা লিখেছেন, সে সম্পর্কে কলম ধরতেই হল।

Advertisement

আমার প্রথম প্রশ্ন হল, বাংলায় গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, এই রকম মন্তব্য করার কোন অধিকারটা বিজেপির রয়েছে? বাংলায় কখনও কোনও গণতান্ত্রিক আন্দোলন কি বিজেপি করেছে? বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রবাহের মধ্যে কখনও যাঁদের দেখা যায়নি, তাঁরা যদি আমাদের গণতন্ত্র নিয়ে জ্ঞান দিতে আসেন, চুপচাপ মেনে নেওয়া কঠিন হয়। সিঙ্গুরে যখন আমরা কৃষিজমি রক্ষার দাবিতে লড়ছি, তখন কোথায় ছিল বিজেপি? হাজার হাজার নাগরিকের বাসস্থান, জীবন, জীবিকা রক্ষার জন্য যখন নন্দীগ্রামে লড়াই চলছিল, তখন বিজেপি কোথায় ছিল? আরও অনেক আন্দোলনের কথা বলা যায়। শুধু সাম্প্রতিকতম উদাহরণগুলোই দিলাম। মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে যখন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামকে বুক দিয়ে আগলাচ্ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তখন কোনও বিজেপি নেতার দেখা তো পাওয়া যায়নি। এখন তৃণমূলকে বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সেই বিজেপি গণতন্ত্র শেখাতে এলে ব্যাপারটা হাস্যকর হয়ে ওঠে।

বাংলায় বিজেপির উত্থান একটা নতুন ব্যাপার। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এ রাজ্যের কিছু লোকসভা আসনে জেতার পর থেকে বাংলার রাজনীতিতে তারা প্রাসঙ্গিক হয়েছে। তার আগে পর্যন্ত তো অপ্রাসঙ্গিক ছিল। আর তৃণমূল নিজের জন্মলগ্ন থেকেই এ রাজ্যের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তিগুলোর একটা। ২০১১ সাল থেকে তৃণমূল এ রাজ্যে ক্ষমতায় রয়েছে। আর তারও দু’বছর আগে থেকে অর্থাৎ ২০০৯ সাল থেকে শুরু করে এই ২০২০ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে যত নির্বাচন হয়েছে, সব ক’টায় তৃণমূলই সবচেয়ে বড় দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। সেখানে মাত্র একটা নির্বাচনে কিছু আসনে ভাল ফল করেই বিজেপি আমাদের গণতন্ত্র শেখাতে শুরু করে দেবে!

Advertisement

আরও পড়ুন: ‘বাংলায় ধ্বংস গণতন্ত্র, এই রাজ বদলাতেই হবে’

দিলীপ ঘোষ দেখলাম তৃণমূলকে ক্ষমতা থেকে সরানোর আহ্বান জানিয়েছেন। এ রাজ্যের ক্ষমতার অলিন্দে বদল আনতেই হবে— এই রকম ডাক দিয়েছেন। তৃণমূলকে সরানোর মতো ভিত কি এ রাজ্যে আদৌ তৈরি হয়েছে বিজেপির? রাজ্য সভাপতি হিসেবে দিলীপ ঘোষের অন্তত সে সব মেপে নেওয়া উচিত ছিল।

‘‘মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে যখন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামকে বুক দিয়ে আগলাচ্ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তখন কোনও বিজেপি নেতার দেখা তো পাওয়া যায়নি।’’—ফাইল চিত্র।

২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর থেকে বিজেপি নেতারা পশ্চিমবঙ্গে হম্বিতম্বি বাড়িয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সেই হম্বিতম্বি টিকবে কত দিন, সে কথা বিজেপি নেতাদের একটু ভেবে দেখা উচিত। এখনও কিন্তু নীচের স্তরে বিজেপির কোনও সংগঠনই তৈরি হয়নি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন জাতীয় রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে হয়েছিল। সেখানে মোদীর মুখ দেখিয়ে কিছু ভোট বিজেপি টেনেছিল। বিধানসভা নির্বাচন তো আর সেই আবহে হবে না। মোদীর মুখও সেখানে প্রাসঙ্গিক হবে না। বিধানসভা নির্বাচনে লড়ার জন্য বুথ স্তর পর্যন্ত মজবুত সংগঠন চাই। তুলে ধরার মতো মুখও চাই। দুটোর কোনওটাই তো বঙ্গ বিজেপির নেই। সুতরাং একমাত্র সম্বল হিন্দুত্বের রাজনীতি। এ ছাড়া আর কোনও হাতিয়ার বিজেপির হাতে নেই। কিন্তু উত্তর বা পশ্চিম ভারতে দাপট দেখাতে থাকা সে হাতিয়ার আবার পশ্চিমবঙ্গে এসে ধার হারিয়ে ফেলে, ভোঁতা হয়ে যায়। হিন্দুত্বের রাজনীতিকে বাংলার মানুষ আগেও গ্রহণ করতেন না, এখনও গ্রহণ করেননি। বিজেপির রাজ্য সভাপতি কিসের ভিত্তিতে তৃণমূলকে উৎখাত করার ডাক দিচ্ছেন, বুঝতে পারছি না। খুব দুর্বল ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে তৃণমূলকে সরানোর কথা বলছেন ওঁরা।

আরও খবর: খুনের তত্ত্বে অনড় দিলীপ, নস্যাৎ ফিরহাদের

যে ঘটনাকে সামনে রেখে বিজেপি রাজ্য জুড়ে একটা হইচই শুরু করার চেষ্টা করছে, তা হল এক বিধায়কের মৃত্যু। সবার আগে মনে রাখতে হবে, উত্তর দিনাজপুরের হেমতাবাদের বিধায়ক দেবেন্দ্রনাথ রায় কিন্তু বিজেপি বিধায়ক ছিলেন না। তিনি ছিলেন সিপিএম বিধায়ক। টাকাপয়সা পেয়েই সম্ভবত বিজেপিতে যান। যে কারণেই গিয়ে থাকুন, আপাতত ইস্যু হল বিধায়কের অস্বাভাবিক মৃত্যুটা। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে পদক্ষেপ করেছে প্রশাসন। সিআইডি তদন্ত শুরু হয়ে গিয়েছে। পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত এবং পোস্টমর্টেম রিপোর্ট জানাচ্ছে, ওই বিধায়ক আত্মহত্যা করেছেন বলেই মনে হচ্ছে। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞও সে কথা বলছেন। কিন্তু বিজেপি নেতারা সে কথা মানতে রাজি নন। রাজি নন কারণ, একটা ইস্যু তো তৈরি করতে হবে। ভোট এগিয়ে আসছে। হার অবধারিত বলে বিজেপি বুঝতে পারছে। তাই বাংলায় গণতন্ত্র নেই বা বাংলায় গণতন্ত্রের হত্যা হচ্ছে বলে আগে থেকেই গান গাওয়া শুরু করতে হবে। হারের অজুহাত আগে থেকে তৈরি রাখতে হবে।

কোন মুখে বিজেপি নেতারা গণতন্ত্র ধ্বংসের অভিযোগ তোলেন বা বিরোধী দলের উপরে আক্রমণের কথা বলেন, আমি জানি না। দিলীপ ঘোষ কি এমন একটা উদাহরণও দিতে পারবেন, যেখানে উনি দেখাতে পারবেন যে, বিজেপি কোনও বিরাট গণআন্দোলন গড়ে তুলেছিল এবং তৃণমূলের সরকার পুলিশ দিয়ে সে আন্দোলন ভেঙে দিয়েছে? এ রাজ্যে বিজেপির কর্মীরা যদি কখনও কোথাও আক্রান্ত হয়েও থাকেন, তা হলে সেগুলো নেহাৎই বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা। স্থানীয় স্তরে বা ছোট ছোট পরিসরে কোনও সঙ্ঘাত হয়েছে, কখনও বিজেপি আক্রান্ত হয়েছে, কখনও তৃণমূল। দিলীপ ঘোষ একটা বড় গণআন্দোলন দেখাতে পারবেন, যেটা বিজেপি গড়ে তুলেছে আর আমাদের সরকারের পুলিশ গুলি চালিয়ে তা ভেঙে দিয়েছে? অনেকে দাঁড়িভিটের কথা বলছেন। মনে রাখতে হবে, দাঁড়িভিটও কোনও বৃহত্তর গণআন্দোলন নয়। একটা স্কুলের শিক্ষক নিয়োগকে ঘিরে স্থানীয় স্তরের উত্তেজনা। সেখানে গুলি চলেছে ঠিকই, কিন্তু গুলি পুলিশ চালিয়েছে, এমন কোনও প্রমাণ নেই।

আরও খবর: ক্ষতিপূরণ-তরজা বিজেপি-তৃণমূলের

বাম জমানার কথা কি মনে করতে পারছেন দিলীপ ঘোষরা? বিরোধীদের একের পর এক আন্দোলন তীব্র বলপ্রয়োগে ভেঙে দেওয়া হয়েছে। বিরোধী দলগুলোর কর্মী-সমর্থকদের উপরে ভয়াবহ আঘাত নেমেছে। ১৯৯৩ সালে খাস কলকাতার বুকে ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে কলকাতায় হাজির হলেন যে যুব কংগ্রেস কর্মীরা, তাঁদের উপরে পুলিশ গুলি চালিয়ে দিল। ১৩ জন শহিদ হলেন। বীরভূমের সূচপুরে কী হয়েছিল? এক দিনে ১১ জনকে খুন করে দেওয়া হয়েছিল। গোটা বাম জমানা জুড়ে বার বার যে কোনও গণআন্দোলন ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। পুলিশ দিয়ে তীব্র বলপ্রয়োগ করা হয়েছে। শাসকআশ্রিত গুন্ডারা বার বার ঝাঁপিয়ে পড়েছে বিরোধীদের উপরে। দিলীপ ঘোষ বলতে পারবেন, এই রকম কোন ঘটনা বিজেপির সঙ্গে ঘটল? কোন গণআন্দোলনটা বিজেপি গড়ে তুলল? আর কোনটাকে পুলিশ দিয়ে বলপ্রয়োগ করে ভেঙে দেওয়া হল? আমরা জানি দিলীপ ঘোষদের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর নেই।

বিজেপি এখন দিল্লি থেকে হিন্দিভাষী নেতাদের নিয়ে আসছে। তাদের দিয়ে গরম গরম কথা বলাচ্ছে। বিপুল খরচ করে বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমকে কিনে ফেলছে। সেই সব সংবাদমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে অপপ্রচারকে জোরদার করে তোলার চেষ্টা করছে। সব মিলিয়ে হাওয়াটা গরম করার চেষ্টা করছে বিজেপি। কিন্তু তাতে বিজেপির লক্ষ্য পূরণ হবে বলে আমার মনে হয় না। কারণ এ রাজ্যের মানুষের মধ্যে নিজেদের শিকড় এখনও ছড়িয়ে দিতে পারেনি বিজেপি।

লেখক: তৃণমূল সাংসদ

উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল সম্পর্কিত যাবতীয় আপডেট পেতে রেজিস্টার করুন এখানে

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন