শ্রী পদ্ধতিতে চাষে নজির মহিলাদের

ধান রোওয়া, ধান কাটা অথবা জমিতে আগাছা পরিষ্কার করার সময়ে খেতে মহিলাদের উপস্থিতি নজরে আসে। তবে, কৃষক বললেই চোখের সামনে প্রথমেই পুরুষদের ছবি ভেসে উঠে। সে ছবি হোক বা গ্রাম-বাংলার মাঠ-মাঠালির চেনা দৃশ্য। সেই দৃশ্যেরই নতুন মোড়ের দেখা মিলছে বীরভূমে।

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত

খয়রাশোল শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৫ ০০:৫৮
Share:

খয়রাশোলের খন্নিগ্রামের মাঠে ধানের জমিতে কাজ করছেন এক বধূ। —নিজস্ব চিত্র।

ধান রোওয়া, ধান কাটা অথবা জমিতে আগাছা পরিষ্কার করার সময়ে খেতে মহিলাদের উপস্থিতি নজরে আসে। তবে, কৃষক বললেই চোখের সামনে প্রথমেই পুরুষদের ছবি ভেসে উঠে। সে ছবি হোক বা গ্রাম-বাংলার মাঠ-মাঠালির চেনা দৃশ্য। সেই দৃশ্যেরই নতুন মোড়ের দেখা মিলছে বীরভূমে। খয়রাশোল সহ জেলার চারটি ব্লকে মহিলা কিষান স্বশক্তিকরণ পরিযোজনা প্রকল্পের (এমকেএসপি) সহায়তায় মাঠে নেমেছেন প্রায় তিনশো মহিলা কৃষক। আধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর শ্রীপদ্ধতিতে চাষে যুক্ত হয়েছেন তাঁরা।

Advertisement

খয়রাশোলের সহ-কৃষি অধিকর্তা দেবব্রত আচার্য বলেন, ‘‘এ ভাবে বাড়ির মহিলারা চাষে এগিয়ে এলে পরিবারে আর্থিক স্বাচ্ছল্য আসবে। অনাবাদী জমিগুলিও কম পড়ে থাকবে। সঙ্গে সঠিক মানের বীজ ঘরের কাছেই পাবেন চাষিরা।’’

জেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে খবর, ধানের চারা রোয়ানো ও ফসল কাটা তো আছেই, বীজ বাছাই থেকে, বীজ শোধন, সার প্রয়োগ থেকে রোগপোকা ও ফসলে রোগের আক্রমণ সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে জ্ঞানে তাঁরা পুরুষ চাষিকে টেক্কা দিচ্ছেন। তাঁদের অনেকেই আছেন যাঁরা গত কয়েক বছর ধরে সফল ভাবে শ্রী পদ্ধতিতে ধান চাষ করছেন। এবং সকলেই প্রায় কোনও না কোনও মহিলা স্বনির্ভর দলের সদস্য। বীজ উৎপাদন করে তা বিক্রি করে নিজেরা যাতে অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা তৈরি করতে পারেন, সেই লক্ষ্যেও বেশে কিছুটা তাঁরা এগিয়েছেন। ইতিমধ্যেই সিড সার্টিফিকেশনের জন্য আবেদন করেছে ইলামবাজার, লাভপুর ও খয়রাশোলের পাঁচ-ছ’টি সংঘ।

Advertisement

এমকেএসপি বা মহিলা কিষাণ পরিযোজনা হল কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় গ্রামীণ জীবিকা মিশনের (এমআরএলএম) একটি উপপরিকল্পনা। বীরভূমে এই পরিকল্পনা রূপায়ণের দায়িত্ব রয়েছে লোককল্যাণ পরিষদ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উপর। ২০১১ সাল থেকেই ওই সংস্থা মহিলা স্বনির্ভর দলের সদস্যদের বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য এনে দেওয়ার কাজে যুক্ত হয়। কৃষিকাজে মহিলাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য দায়িত্বে থাকা লোককল্যাণ পরিষদের সদস্যরা এই কাজ করে চলেছেন। এবং সেই উদ্যোগেরই প্রথম দিকে লাভপুর ও ইলামবাজারে যথেষ্ট সফল ভাবে কাজ হয়।

স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের এক সক্রিয় কর্মী সুমনা মজুমদার বলেন, ‘‘মহম্মদবাজার ও খয়রাশোল ব্লকের স্বনির্ভর দলের মহিলা সদস্যদের এ কাজে আগ্রহী করতে সমর্থ হয়েছে আমাদের সংগঠন। এই অঞ্চলে খরার জন্য বেশ কিছু জমি অনাবাদী পড়ে থাকে। বর্ষা এবার অকৃপণ হলেও সেচের অভাবে জমি থাকা সত্ত্বেও প্রান্তিক চাষির পরিবারে পুরুষেরা বিকল্প পেশা খোঁজে। সেখানে কৃষি কাজে মহিলারা এগিয়ে এলে সব দিক রক্ষা হয়।’’ মহিলাদের আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর চাষে আগ্রহী করার পথে এই সংগঠন কখনও সহায়তা পেয়েছে নাবার্ডের। কখনও বা কৃষি দফতরের “আত্মা” (এগ্রিকালচারাল টেকনোলজি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি)-র।

এ বছর খয়রশোলের খন্নিগ্রামে ৫৩ বিঘা জমিতে শ্রী পদ্ধতিতে ধান চাষ করছেন ওই গ্রামের ৯টি স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ৭০ জন সদস্য। মোট চাষের সাড়ে সাত বিঘা বীজ উৎপাদনের জন্য চিহ্নিত। বীজ অনুখাদ্য সার সবই যৌথ ভাবে দেওয়া হয়েছে। আরও উল্লখযোগ্য, ৯টি মহিলা স্বনির্ভর দলের ৭০ জন সদস্যই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত। সাধারণত কৃষিকাজে যাঁদের অংশগ্রহণ সচারাচর দেখাই যায় না। প্রকল্প রূপায়ণের দায়িত্ব থাকা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে সহায়তা করছে আত্মা। মহিলাদের চাষে উৎসাহ দেখার পর ওই গ্রামে একটি প্রদর্শন ক্ষেত্র প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জেলা উপ কৃষি অধিকর্তা(বিশ্ব ব্যাঙ্ক প্রকল্প) তথা আত্মা-র জেলা প্রকল্প আধিকারিক তপন ভাণ্ডারী। তপনবাবু বলেন, ‘‘সংখ্যালঘু মহিলাদের চাষে উৎসাহ দেখেই আমরা সাহায্যে এগিয়ে এসেছি। এটা অন্যান্য ব্লকের কাছে একটা ভাল বার্তা, সন্দেহ নেই।’’

মাতঙ্গিনী সংঘের আওতাভুক্ত হওয়ায় বীজ উৎপাদন ও বিক্রি করার জন্য খয়রাশোলের খন্নি গ্রামের স্বনির্ভর দলের সদস্যরা ওই সংঘের মাধ্যমেই লাইসেন্সের জন্য আবেদন জানিয়েছেন সিড কর্পোরেশনে। জেলা সহ-কৃষি অধিকর্তা (সিড সার্টিফিকেশন) মিনাজুর হাসান বলেন, ‘‘এ বারই খয়রাশোল ছাড়াও ইলামবাজার ও লাভপুরের কয়েকটি সংঘ বীজ উৎপাদন ও তা বিক্রি করার জন্য ছাড়পত্রের আবেদন করেছে। বীজের মান পরীক্ষা করে তবেই ছাড়পত্র মিলবে। তবে বিষয়টি সফল হলে তুলনামূলক ভাবে কম পয়সায় পড়শি বা জেলার অন্য অংশের চাষিরা তা সংগ্রহ করতে পারবেন। এতে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছল্যের মুখ দেখবেন মহিলা কৃষকেরা।’’

ডিম ভাসার মতো নুন জলে ধানের বীজ বাছাই করা, বীজ শোধন করা এবং সেই বীজ থেকে উৎপাদিত চারা ১২ দিন পরে শ্রী পদ্ধতিতে ১০ ইঞ্চির তফাতে জমিতে রোওয়ার বিবরণ দিতে গিয়ে খন্নিগ্রামের নাসিমা বেগম, লুৎফাবিবি, আঙ্গুরা বিবিরা জানান, ‘‘অনেক আশা নিয়ে আমরা মাঠে নেমেছি। হাতে-কলমে খুব যত্ন নিয়ে শিখেছি কী ভাবে জমির আগাছা পরিষ্কার করার আধুনিক যন্ত্র কনুইডার চালাতে হয়। আশা, লাভের মুখ দেখব।’’

লোককল্যাণ পরিষেদের জেলা প্রকল্প ম্যানেজার দুর্গা ভট্টাচার্য ও সদস্য সুমনা মজুমদাররা জানাচ্ছেন, এই পদ্ধতিতে চাষের বেশ কিছু সুবিধা আছে বলেই মহিলাদের শেখানো হয়েছে। একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে একটি করে চারা রোওয়া হয়। প্রথাগত ধান চাষের তুলনায় বীজ অনেক কমও লাগে। জল, সার, অনুখাদ্য, কৃষি শ্রমিক সবই কম লাগে। সেই জন্যই জেলার নানা প্রান্তের মেয়েরা এগিয়ে আসছেন চাষের কাজে। সংস্থার হিসাবে, খয়রাশোল ছাড়াও লাভপুরে ১৪২ বিঘা, ইলামবাজারে ৭০ বিঘা ও মহম্মদবাজারে ২০ বিঘা জমিতে এই পদ্ধতিতে ধান চাষ হচ্ছে। যেহেতু মহিলারা বীজ বাছাই ও শোধনের কাজটা খুব যত্ন নিয়ে করেন, তাই ফলও আশাব্যঞ্জক।

বিলাতি পঞ্চায়েতের পূর্ব-নারায়ণপুরের ভারতী স্বনির্ভর দলের সদস্য বাণী গড়াই বলেন, ‘‘গত তিন বছর ধরে ওই সংস্থার পরামর্শ ও সহযোগিতায় শ্রীপদ্ধতিতে ধান চাষ করে ভাল ফল পেয়েছি। প্রথমে কয়েক কাঠা জমিতে চাষ করলেও এ বার ২ বিঘা জমি চাষ করেছি।

একই কথা বলছেন ওই ব্লকের ঘুরিষা পঞ্চায়েতের শ্রীপুরের বাসিন্দা মণিজা বেগম। বন্যায় প্রথমবার চাষ নষ্ট হলেও দ্বিতীয়বার বীজতলা তৈরি করে ধানচাষ করেছেন লাভপুরের থিবা পঞ্চায়েতের কাঁদরকুলার যূথিকা মণ্ডল, লাভপুরের চৌহাট্টার নবনীতা চক্রবর্তীরা। তাঁরা বলেন, ‘‘শুধু ধান চাষ নয়, নাইট্রোজেনের অভাব দূর করতে ধঞ্চে চাষ, জৈব কেঁচোসার তৈরি করা, বন্ধুপোকা শত্রুপোকা চেনা এবং ঘরোয়া পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষণ সবটাই আমরা শিখেছি। এগিয়ে আসছে পুরুষরাও।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন