বঙ্গ জুড়ে মেলার মেলায় সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের পসরা

সেটা ছিল ইসলামপুরের ইউসুফগঞ্জের মেলা। ফি বছর নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে উর্‌স্‌ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নিজের মনেই ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। বয়স, তা প্রায় ৬৫ বছর হবে। দেখলাম মেলার প্রায় অনেক দোকানদার তাঁকে চেনেন। কুশল বিনিময় করছিলেন। সেটাই আমাকে টানল। তখনই আলাপ জুড়ে দিয়েছিলাম। মেলা মানেই মেলা মানুষ। তাঁদের মধ্যে মেলা রসিককে খুঁজে পাওয়া গেলে তো কথাই নেই।

Advertisement

রতন বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৬ ২২:০১
Share:

সেটা ছিল ইসলামপুরের ইউসুফগঞ্জের মেলা। ফি বছর নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে উর্‌স্‌ মেলা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নিজের মনেই ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন তিনি। বয়স, তা প্রায় ৬৫ বছর হবে। দেখলাম মেলার প্রায় অনেক দোকানদার তাঁকে চেনেন। কুশল বিনিময় করছিলেন। সেটাই আমাকে টানল। তখনই আলাপ জুড়ে দিয়েছিলাম। মেলা মানেই মেলা মানুষ। তাঁদের মধ্যে মেলা রসিককে খুঁজে পাওয়া গেলে তো কথাই নেই।

Advertisement

আলাপের পরে জানলাম তাঁর নাম নিখিলেশ সিংহ। তাঁর বয়স ষাটের কোঠায়। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম অনেক কথাই। জানা গেল, আগে হাতি-ঘোড়াও এখানে বিক্রি হত। মেলায় উটের বিক্রি ভাল হয়। দেশভাগের আগে ওপার বাংলা থেকেও বহু লোক মেলায় আসতেন।

সে মেলার কাহিনি এ রকম। ১৯০৯ সালে জমিদার ইউসুফ চৌধুরী এই মেলার সূচনা করেন। তিনি প্রজাদের অর্থনৈতিক উন্নতি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, চিত্ত বিনোদনের কথাও ভেবেছিলেন। ১৯৬০ সালে ইসলামপুরের বিধায়ক মহম্মদ আফাক চৌধুরী পীর ফজলে রব্বির স্মরণে এই মেলার নামকরণ করেন উর্‌স্ মেলা। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় এই মেলাকে দু’মাস ধরে চালানোর অনুমতি দেন। মেলা প্রাঙ্গণে পীর রব্বির মাজার করা আছে। সেখানে সব ধর্মের মানুষই পুজো দেন। মেলায় জলসায় কাওয়ালি গান পরিবেশিত হয়। এই মেলার অন্যতম আকর্ষণ উটের পসরা।

Advertisement

প্রকৃত মেলা গ্রাম বা পল্লিকেন্দ্রিক। কোনও মেলার তারিখ নির্দিষ্ট, আবার কোনও মেলা তিথি নক্ষত্র বা চাঁদের গতিবিধি মেনে পালিত হয়। উত্তরবঙ্গের উৎসব মোঙ্গলয়েড-অস্ট্রিক-দ্রাবিড় প্রভৃতি নৃ-গোষ্ঠী মিলনে লালিত। কোথাও পুরুষ, কোথাও নারী দেবতা, আবার কোথাও ইসলামি অনুষঙ্গ, কোথাও বৌদ্ধ, বৈষ্ণব, সুফি মিশে আছে।

উত্তরবঙ্গে সারা বছর মেলা লেগেই থাকে। তার মধ্যে শীতের মেলাই বেশি। উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জের কানাইপুর গ্রামে অগ্রহায়ণ মাসের অমাবস্যায় বনকালীর পুজো অনুষ্ঠিত হয়। নরেন বর্মন এই বনকালীর পুজোর সূচনা করেন। এই মেলা তিন দিন ধরে চলে। মেলায় মণিহারি, মিষ্টির দোকান ছাড়াও কাপড়ের দোকান বসে। মেলায় বাউল গান পরিবেশিত হয়।

প্রতি বছর ২৫ ডিসেম্বর রায়গঞ্জের ছোট পারুয়া মিশনে যীশুর জন্মদিন খুব নিষ্ঠা ও জাঁকজমক সহকারে পালিত হয়। ১৯৬২ সালে আলবিমুস কুজুর একটি ছোট ঘরে যীশুর উপাসনা শুরু করেন। বর্তমানে কোটি টাকা ব্যয়ে সেখানে একটি সুরম্য গীর্জা স্থপিত হয়েছে। বড়দিনে সেখানে মেলা বসে। সব ধর্মের পীঠস্থানে পরিণত হয়েছে মেলাটি।

চোপড়ার কাছে ডক নদীর ধারে দশুয়া গ্রাম। স্থানীয় অধিবাসীরা ডক-কে গঙ্গার মতো পবিত্র বলে মানেন। সেখানে ১৮৯৩ সালে পাহাড় সিংহের উদ্যোগে গঙ্গা, শিব ও রাধাকৃষ্ণের পুজো শুরু হয়। পরে সেখানে মন্দির স্থাপিত হয়। প্রতি বছর মাঘীপূর্ণিমায় মন্দিরের বাৎসরিক পুজোর আয়োজন হয়। এখানেও এক মাস ধরে পুজোকে কেন্দ্র করে মেলা চলে। চোপড়ার এটিই সবচেয়ে বড় মেলা। এখানে বাউল গানের প্রতিযোগিতা বিশেষ আকর্ষণ। এ ছাড়া চলতি বিনোদনের সবই পাওযা যায় এখানে। আরও একটি আকর্ষণ চিতল মাছের পসরা।

দক্ষিণ দিনাজরপুরে বালুরঘাটের কাছে বোল্লা কালীবাড়ি। রাস পূর্ণিমার পরের শুক্রবার এখানে পুজো শুরু হয়েছিল প্রথম। এই পুজো অন্তত দুশো বছরের পুরনো। সাত ফুট বোল্লাকালীর মেলায় তিন থেকে চার হাজার পাঁঠা বলি হয়। গভীর রাতে মহিষও বলি হয়। তবে প্রধান প্রসাদ হল কদমা।

পুরনো মালদহের মোকাতিপুর কলোনির জুয়ার মেলা অভিনব। মুলো ষষ্ঠীতে বসে এই জুয়া বা শেউড়ির মেলা। অগ্রহায়ণের শুক্লা ষষ্ঠীতে একদিনের এই মেলাকে কেন্দ্র করে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জুয়া খেলেন। ষষ্ঠীর পুজোও হয়। মূর্তিটি লক্ষ্মীমূর্তির আদলে গড়া হয়। ঔপনিবেশিক আমল থেকে এই মেলা চলে আসছে।

মালদহের গাজলে ধাওয়েল গ্রামে মাঘীপূর্ণিমায় কংসব্রত বা কাসব পুজো। ওই গ্রামে কংসের বেদিতে যে পাথরের মূর্তি আছে তার বুকের উপরের অংশ নেই এবং পা দুটোও হাঁটু থেকে ভাঙা। বুকে পৈতে। এই উৎসব সম্পর্কে জনশ্রুতি আছে, এখানেই নাকি কৃষ্ণ কংসবধ করেছিলেন। স্থানীয়দের দাবি, এই মেলা সাড়ে চারশো বছরের পুরনো। হাজার দশেক মানুষ এই মেলায় আসেন। জিনিসের পসরার সঙ্গে কবিগানের আসর বসে।

মালদহের ইংরেজবাজারের মীরচক মহল্লার লাঠিখেলা মাঠের মহরম মেলা বিখ্যাত। দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটের অমৃতখণ্ডের মহরম মেলারও নাম আছে। দক্ষিণ দিনাজপুরেরই তপনের হজরতপুর গ্রামের মহরমের মেলাও এলাকায় নামকরা। এই জেলারই বংশীহারির ল্যাংড়া পীরস্থানের উৎসব ও মেলা বেশ পরিচিত। দার্জিলিং জেলার খড়িবাড়ির চুনীলালজোতের মহরমের মেলা প্রায় একশো বছরের পুরনো। দিনহাটার মহরমের মেলাও পরিচিত।

কোচবিহার জেলায় রাসপূর্ণিমায় মদনমোহন বাড়ির রাসের মেলা শতবর্ষেরও বেশি পুরনো। এই মেলার আকর্ষণ রাসচক্র। বাংলার পর্যটন মানচিত্রে এই মেলা জায়গা করে নিয়েছে।

জলপাইগুড়ির জল্পেশ মন্দিরে শিবের পুজোকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর শিব চতুর্দশীর মেলাও বিখ্যাত। এটিই উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে প্রাচীন ও সর্ববৃহৎ মেলা। আগে পনেরো দিন ধরে চললেও এখন এক সপ্তাহ ধরে চলে। পসরার পাশাপাশি লোকগানের আসরও এখানকার বিশেষ আকর্ষণ। গত বার এই মেলায় গিয়েছিলাম। দেখা স্কুলশিক্ষক হরিপদ রায়ের সঙ্গে। তিনিই জানান, এই মেলায় উত্তরবঙ্গের সাতটি জেলা থেকে বহু লোক আসেন। বাইরের পর্যটকেরাও সুযোগ পেলে ঘুরে যান। আগে ভুটানিরাও মেলায় যোগ দিত। তবে এখন তাঁরা বিশেষ আসেন না।

এ ছাড়া উত্তরের শীতের মেলা প্রচুর আছে। শীতে সব জায়গায় বসে বইমেলা। বই বিক্রির সঙ্গে চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। এ ছাড়া পুষ্পমেলা, খাদ্যমেলা, হস্তশিল্প মেলা, বিবেক মেলা উল্লেখ করা যায়। গ্রামীণ অর্থনীতি বিকাশে সুদীর্ঘকাল মেলাগুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। সময়ের সঙ্গে মেলার বিবর্তন হয়েছে। ক্রমশ বদলে যাচ্ছে পরম্পরার ঐতিহ্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন