বিক্ষোভ চলল তিন ঘণ্টারও বেশি। মঙ্গলবার খড়দহ স্টেশনে সজল চট্টোপাধ্যায়ের তোলা ছবি।
অনিয়মিত ট্রেন চলাচলের প্রতিবাদে যাত্রীদের মধ্যে চাপা আগুন ছিলই। মঙ্গলবার সেই আগুনে ঘি পড়ল খড়দহ স্টেশনে একটি ভুল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে। টানা সওয়া তিন ঘণ্টা অবরোধ করে মেন লাইনের ট্রেন চলাচল বিপর্যস্ত করে দেন যাত্রীদের একাংশ। আর তার জেরেই এ দিন সকাল থেকে নাকাল হন হাজার হাজার সাধারণ যাত্রী।
শিয়ালদহ থেকে পর পর বাতিল করা হয় লোকাল। মাঝপথেই ঘুরিয়ে দেওয়া হয় অনেক ট্রেন। দীর্ঘ ক্ষণ ট্রেন না পেয়ে ভিড় আছড়ে পড়ে রাস্তায়। বাদুড়ঝোলা অবস্থা হয় বাস-অটোতে। যার জেরে অনেকেই এ দিন গন্তব্যে পৌঁছতে পারেননি বলে খবর।
ঠিক কী হয়েছিল এ দিন?
মঙ্গলবার, সকাল সাড়ে আটটা। অন্য দিনের মতোই অফিসের ব্যস্ত সময়ে ভিড়ে ঠাসা ছিল স্টেশনের ২ নম্বর প্ল্যাটফর্ম। হঠাৎ প্ল্যাটফর্মের মাইকে ঘোষণা করা হয়, ‘দু নম্বর প্ল্যাটফর্মে ডাউন ব্যারাকপুর লোকাল আসছে’। আদতে ট্রেনটি গ্যালপিং। তাই খড়দহে সেটি থামার কথা নয়। কিন্তু ঘোষণা শুনে যাত্রীরা ভেবেছিলেন, এ দিন বোধ হয় ট্রেনটি খড়দহে থামবে। ফলে যাঁরা ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ছিলেন, তাঁরাও ছুটে আসতে থাকেন ২ নম্বরে। আর সেই সময়েই ট্রেনটি থেমে দুর্বার গতিতে ছুটে পেরিয়ে যায় খড়দহ স্টেশন।
বড় দুর্ঘটনা ঘটতেই পারত। ঘটেনি। কিন্তু ট্রেন কেন থামল না, কেনই বা ঘোষণায় গ্যালপিং ট্রেনের কথা বলা হল না, তা নিয়েই শুরু হয় বিক্ষোভ। দেখতে দেখতেই বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা বাড়ে। কেউ কেউ বলতে থাকেন, ‘‘সময় মতো ট্রেন তো চলছেই না, উল্টে খড়দহ ও আগরপাড়ায় নিত্য এমন ঘটছে। কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে না।’’ ঘটনাস্থলে শিয়ালদহের ডিভিশনাল রেলওয়ে ম্যানেজারকে আসতে হবে বলেও দাবি তোলেন বিক্ষোভকারীরা। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাঁকে আসতে হয়নি। বিক্ষুব্ধ যাত্রীদের সঙ্গে রেল পুলিশ ও অন্যান্য কর্মীরা ঘণ্টা তিনেক কথা বলে বেলা বারোটা নাগাদ অবরোধ তুলে দিতে সক্ষম হন।
ক্ষোভ তবু থাকছেই। যাত্রীদের বক্তব্য— আজ বৃষ্টি, তাই সিগন্যাল খারাপ। কাল আবার সামান্য হাওয়া দিয়েছে, তাই ওভারহেড তার ছিঁড়ে গিয়েছে। কোনও দিন আবার গার্ড আসছে, তো চালক নেই। ফলে ট্রেনের দেরি প্রায় রোজকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিযোগ, রোজ অন্তত ২০ মিনিট দেরিতে চলছে ট্রেন।
কিন্তু এর সুরাহা নেই কেন? রেল কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, যাঁরা ট্রেন চালানোর সঙ্গে যুক্ত, যাত্রীদের অসুবিধাটা তাঁরা বুঝতেই চান না। বিশেষ পর্যবেক্ষণ বা নজরদারিও নেই। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। পুজোর অনেক আগে থেকেই শিয়ালদহে এই অব্যবস্থা চলছে। পুজোর ক’টা দিন ছুটি ছিল। তাই টের পাওয়া যায়নি। এ বার স্কুল-কলেজ, অফিস-কাছারি খুলতেই ফের ঝুলি থেকে বেরিয়ে পড়েছে শিয়ালদহের সেই ‘অনিয়মের বেড়াল’।
ধারাবাহিক এই অব্যবস্থা কথা কথা কানে গিয়েছিল রেল-বোর্ডের কর্তাদেরও। সোমবার কলকাতায় এসে রেল-বোর্ড সদস্য (ট্র্যাফিক) মহম্মদ জামশেদ মঙ্গলবার সকালে তাঁর শিয়ালদহ পরিদর্শনের কথা জানান। আর সে কথা শুনে শিয়ালদহের কর্তারা সোমবার রাতেই প্ল্যাটফর্মের মেঝেতে রাতারাতি গাছ বসিয়ে সৌন্দর্যায়নের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সবই ভেস্তে গেল খড়দহের ঘটনায়।
রেল সূত্রের খবর, যাত্রী বিক্ষোভের আশঙ্কায় তড়িঘড়ি শিয়ালদহ পরিদর্শন স্থগিত করে দিয়ে কর্তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাওড়া স্টেশনে। সেখানে তিনি অবশ্য শিয়ালদহের সমস্যার কথা স্বীকার করে নিয়ে বলেছেন, ‘‘সমস্যা রয়েছে জানি। তবে এ দিন খড়দহে যা ঘটেছে তা ঠিক হয়নি। রেলের তথ্য-প্রযুক্তি এখন অনেক উন্নত। সেখানে দাঁড়িয়ে ওই ভুল কাম্য নয়।’’
শিয়ালদহের যাত্রী পরিষেবা নিয়ে বিরক্ত রাজ্য সরকারও। এ দিন রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘‘যাত্রী পরিষেবা ঠিক করে দেওয়াটা রেলেরই দায়িত্ব। বারবার এই ধরনের ঘটনা রেলের দায়িত্বজ্ঞানহীনতারই পরিচয়। প্রয়োজনে আমরা রেলের সঙ্গে কথা বলব।’’ তবে ট্রেন পরিষেবা নিয়ে যাত্রীদের জমতে থাকা অভিযোগের ভিত্তিতে রেল-বোর্ড কর্তা এ দিনই পূর্ব রেলের চিফ কমার্শিয়াল ম্যানেজার ও চিফ অপারেশনস ম্যানেজারকে খতিয়ে দেখে রিপোর্ট দিতে বলেছেন।