দুর্লভ পাখি, লাল-টুপি ছাতারে। ছবি: জ়েডএসআই সূত্রে প্রাপ্ত।
দক্ষিণবঙ্গের দুই নদের অববাহিকার তৃণভূমিতে এক দুর্লভ পাখি, চেস্টনাট-ক্যাপড ব্যাবলার (লাল-টুপি ছাতারে)-এর প্রজনন ও বাসা বানানোর অভ্যাস নিয়ে প্রথমবারের মতো গবেষণা করলেন জুলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (জ়েডএসআই)-এর গবেষকেরা। জিআইএস প্রযুক্তির সাহায্যে তাঁরা হাওড়া জেলায় এই পাখির আবাসক্ষেত্রের মানচিত্রও তৈরি করেছেন।
এই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত জেডএসআই-এর বিজ্ঞানী কৌশিক দেউটি জানিয়েছেন, তাঁদের গবেষণা সংক্রান্ত নিবন্ধ পক্ষীবিদ্যা বিষয়ক জার্নাল ‘ইন্ডিয়ান বার্ডস’-এর সাম্প্রতিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘এই অঞ্চলে এই প্রজাতির প্রজনন ও বাসা বাঁধার এত বিশদ ও প্রামাণ্য নথি আগে কখনও তৈরি হয়নি। ফলে, এই গবেষণা দক্ষিণবঙ্গে পাখি পর্যবেক্ষণের ইতিহাসে নতুন মাত্রা যোগ করল।’’
কৌশিক জানান, মূলত পোকামাকড়খেকো, লাজুক স্বভাবের চেস্টনাট-ক্যাপড ব্যাবলার পাখি, কাশবন আর ঘন তৃণভূমির আড়ালে নিজেকে নিঃশব্দে লুকিয়ে রাখে, ফলে তাকে সহজে দেখা যায় না সেভাবে। ব্রিটিশ আমলে দক্ষিণবঙ্গে এই পাখির অস্তিত্বের নিদর্শন মিললেও এতদিন পর্যন্ত বিশদে পর্যবেক্ষণ হয়নি কতকটা তার আত্মগোপনকারী এই স্বভাবের জন্যে।
জেডএসআই-এর গবেষক দলটি ২০২২-এর ডিসেম্বর থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত রূপনারায়ণ ও দামোদরের তীরবর্তী বিভিন্ন ঘাসজমিতে মোট ২৩টি স্থানে এই প্রজাতির পাখিটির উপস্থিতি নথিভুক্ত করেছেন। যার মধ্যে ১৮টি জায়গা রূপনারায়ণের তীরে এবং ৫টি জায়গা দামোদরের তীরে। সেই স্থানগুলি কাশ ও খড়ির মত উঁচু ঘাসে পূর্ণ এবং অরক্ষিত। গবেষকদলের সদস্য শেখর প্রামাণিক বলেন, ‘‘বর্তমানে ওই এলাকাগুলির বেশ কয়েকটি বিপদাপন্ন। কারণ, গাঁদা ও জবাফুলের বাণিজ্যিক চাষের জন্য ঘাস কেটে ও পুড়িয়ে সাফ করা হচ্ছে। আর তাতে লুপ্ত হচ্ছে ঘাসজমি নির্ভর পাখিদের আশ্রয়স্থল।’’
তিনি জানান, এদের মধ্যে চেস্টনাট-ক্যাপড ব্যাবলার ছাড়াও রয়েছে আরও বেশ কিছু পাখি— স্ট্রায়েটেড ব্যাবলার, বিভিন্ন প্রজাতির মুনিয়া, টুনটুনি গোত্রের প্রিনিয়া ও বাবুইয়ের দু’টি প্রজাতি। কৌশিক বলেন, উল্লেখযোগ্য ভাবে এই গবেষণায়, চেস্টনাট-ক্যাপড ব্যাবলার পাখিটির মধ্যে পূর্বে নথিভুক্ত না হওয়া যৌন দ্বিরূপতার প্রমাণ মিলেছে। যা নতুন পর্যবেক্ষণ। যৌন দ্বিরূপতা বলতে একই প্রজাতির স্ত্রী ও পুরুষের দৃশ্যমান পার্থক্যকে বোঝানো হয়। শেখর এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘আমরা চোখের আইরিশ অংশে রঙের স্পষ্ট পার্থক্য লক্ষ্য করেছি। পুরুষ পাখির চোখের আইরিশ অংশটি লাল আর স্ত্রী পাখির আইরিশ অংশটি কালো। শুধু মাত্র লালচোখ বিশিষ্টেরাই প্রজনন মরসুমে গান গেয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়।’’
গবেষকরা চেস্টনাট-ক্যাপড ব্যাবলার পাখির তিন ধরনের ডাক রেকর্ড করেছেন। প্রথমটি বিপদ সঙ্কেত, দ্বিতীয়টি এলাকা দখলের ঘোষণা এবং তৃতীয়টি প্রজননকালীন আহ্বান। এই আবিষ্কার বাংলার সীমিত পাখির শব্দ-সংগ্রহশালায় এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। শেখর জানান, ২৩টি স্থানের মধ্যে চারটিতে পাখির প্রজননের প্রমাণ ও বাসা পাওয়া গিয়েছে। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে বাসা বাঁধার তথ্য নথিভুক্ত হয়েছে। কিন্তু সেই সব বাসাগুলির বেশ নষ্ট হয়ে গিয়েছে ফুলচাষের ঘাস জমিতে আগুন লাগানোর ফলে।
শেখর বলেন, ‘‘দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, প্রজননের এই স্বল্প সময়ের মধ্যে ঘাসে আগুন ধরানো হচ্ছে। ফলে পাখিরা বাসা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে অনেকক্ষেত্রেই।’’ জেডএসআই-এর ডিরেক্টর ধৃতি বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বাস্তুতন্ত্র জলাভূমি এবং ঘাসজমির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের অপরিণামদর্শী আচরণ তাদের অস্তিত্বের সঙ্কট তৈরি করছে। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, জলাভূমি এবং ঘাসজমির বাসিন্দা প্রাণীকুলও। পরিবেশের ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে।’’ হাওড়া জেলায় লাল টুপির ছাতারেদের প্রজননক্ষেত্রগুলি চিহ্নিত করা এবং প্রয়োজনীয় তথ্য সংকলনের জন্য গবেষকদলকে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি জেডএসআই-এর প্রধান বলেন, ‘‘আমরা চাই চেস্টনাট-ক্যাপড ব্যাবলারের মতো পাখিরা বেঁচে থাকুক। আর তার জন্য আমাদের জরুরি ভিত্তিতে তাদের আবাসস্থল রক্ষা করতে হবে।’’