সকাল দেখে শেষ বিকেলটা বোঝা যায়নি।
সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা আর ঘিয়ে রংয়ের শালে সেজেগুজে মদন মিত্র যখন সকালে সিজিও কমপ্লেক্সের গেটের সামনে গাড়ি থেকে নামলেন, চোখে-মুখে তখনও সেই পরিচিত মেজাজ। গাড়ির বাইরে পা রেখেই ডান হাতে চাদরের খুঁটটা ছুড়ে দিলেন বাম কাঁধে। খানিকটা পিছলে নেমে এল সেটা। মদন তখন কপাল কুঁচকে দেখছেন চারপাশে ঘিরে থাকা আলোকচিত্রীদের ভিড়কে। হাত তুলে পাশের পুলিশকে কী একটা বললেন। তার পরে হাঁটা লাগালেন হনহন করে। বাইরে তখন মেঘলা আকাশ, কনকনে হাওয়া হুল ফোটাচ্ছে। কাচের দরজার সামনে থমকে থেমে আরও এক বার শালের খুঁটটা ঠিক করলেন মন্ত্রী। সঙ্গী পুলিশ কাচের দরজা ঠেলে ধরতে সিজিও কমপ্লেক্সের ভিতরে পা রাখলেন। তার পরেই ঘুরে দাঁড়ালেন। ফের হাত উঁচিয়ে পুলিশকে কিছু বললেন। এ বার তা শোনা গেল “এত ক্যামেরা কীসের! কী করতে চায় এরা?” সিবিআইয়ের এক অফিসার হাত তুলে দেখিয়ে দিলেন সিঁড়ি ভেঙে উঠতে হবে। হনহন করে উঠে চললেন মদন। চোখেমুখে তখনও সেই বিরক্তি মাখা বেপরোয়া অভিব্যক্তি। উঠতে উঠতেই বললেন, “এখানেও ক্যামেরা ঢুকে পড়েছে!” তার পরে বাঁক নিয়ে উঠে গেলেন দৃষ্টিসীমার বাইরে।
সকাল ১০টা ৫৫ মিনিটে মদন যখন সিবিআই দফতরে হাজিরা দিতে এলেন, তখনও সেখানে তাঁর অনুগামীরা বড় একটা ছিল না। ছিল না পরিচিত ‘মদন মিত্র জিন্দাবাদ’ স্লোগানও। সন্ধে নামার আগে তাঁর গ্রেফতারের খবর ছড়িয়ে পড়ার পরে কিছু অনুগামী ভিড় জমালেন বটে, কিন্তু তাঁদেরও সংখ্যা বড় জোর জনা তিরিশ। চোয়াল শক্ত করে দাদার নামে জিন্দাবাদ স্লোগান দিয়ে গেলেন তাঁরা।
কিন্তু কোথায় গেল তাঁর হাজার হাজার অনুগামীর দল? সারদা-কাণ্ড নিয়ে তদন্তে নামার পর এই সিজিও কমপ্লেক্সে শাসক দলের অনেককেই জেরা করেছে সিবিআই। সেই তালিকায় যেমন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতো অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী রয়েছেন, তেমনই ছিলেন কুণাল ঘোষ, সৃঞ্জয় বসুর মতো তৃণমূল সাংসদ। কিন্তু সিজিও কমপ্লেক্সে এঁদের নিয়ে পুলিশ ও সংবাদমাধ্যমের যতটা টানাপড়েন ছিল, সাধারণ মানুষের ততটা উৎসাহ ছিল না।
কিন্তু তিনি মদন মিত্র। রাজ্যের পরিবহণ ও ক্রীড়ার মতো দুই গুরুত্বপূর্ণ দফতরের মন্ত্রী। মমতার ঘনিষ্ঠ বৃত্তের এই সেনাপতির জন্য কলকাতা ও কামারহাটির হাজার হাজার অনুগামী জান দিয়ে দিতে পারেন এমন কথা দলের মধ্যেই ঘোরাফেরা করে।
কিন্তু শুক্রবার সকালে সিবিআই দফতরের সামনে এসে দাঁড়াল, তখন পুলিশ আর সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা ছাড়া হাতে গোনা কিছু অনুগামীই সেখানে উপস্থিত!
মদনের মতো রাজ্য মন্ত্রিসভার হেভিওয়েট মন্ত্রী আসবেন বলে এ দিন সকাল সাড়ে ১০টা থেকে কমপ্লেক্সে একের পর এক গাড়ি ঢুকতে শুরু করে। একটি দুধ সাদা সেডান গাড়ি চড়ে আসেন পরিবহণ মন্ত্রী। গাড়ি থামতেই সেটা ঘিরে ফেলে রাজ্য পুলিশ। কোনও সাংবাদিককে তাঁর ধারেকাছে ঘেঁষতে না-দেওয়া হলেও কয়েক জন আগে থেকেই ভিতরে ঢুকে যান। তাঁদের দেখেই পুলিশের ওপর খেপে যান মদন। হাত উঁচিয়ে বলেন, “ওরা ঢুকলো কী করে?” সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ রে রে করে তেড়ে এসে তাঁদের জোর করে টেনে বার করে দেয়। মন্ত্রী ঢুকে গেলেও তাঁর গাড়ি দেখেই এক পুরুষ কণ্ঠের কটাক্ষ ভেসে আসে এটাই কি সারদা দিয়েছিল? পরে জানা যায়, গাড়িটি বাঙুরের বাসিন্দা প্রকাশ দের।
কিন্তু ভিতরে কী করছেন মন্ত্রী? তাঁকে কি জেরা করা শুরু করেছেন গোয়েন্দারা? নাকি বসিয়ে রাখা হয়েছে? তিনি কি খেয়েছেন? শরীর ঠিক আছে? গোটা দুপুর এমন বহু প্রশ্ন আর তার না-জানা উত্তর ঘুরপাক খেয়েছে কমপ্লেক্সের বাইরে-ভিতরে। সূত্রের খবর, মন্ত্রী হেঁটেই তিনতলায় ওঠেন। তাঁকে সিবিআইয়ের জয়েন্ট ডিরেক্টর রাজীব সিংহের ঘরে বসানো হয়। ওই ঘরেই ছিলেন ডিআইজি শঙ্খব্রত বাগচীও। প্রায় চার ঘণ্টা দফায় দফায় জেরা চলে। মাঝখানে চিনি-ছাড়া এক কাপ লাল চা আর বিস্কুট খান মদন। টুকটাক কিছু খাবারও খান। পরে ফের জেরা শুরু হয়। এরই মধ্যে সিবিআই কর্তাদের কয়েক জন দু’তিন বার নীচে নামেন। তাঁদের দেখে বার বারই সাংবাদিকেরা ছুটে গিয়েছেন। কেউ মুচকি হেসে পাশ কাটিয়েছেন, কেউ বলেছেন, “দেখুন না কী হয়!” কিন্তু দাদাকে কখন ছাড়বে সিবিআই, মন্ত্রীর এক অনুগামী অরুণ সেনগুপ্ত সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ছটফট করেছেন। এসেছেন বরাহনগর থেকে। বলেন, “স্টেডিয়ামে অনেকে অপেক্ষা করছেন। দাদা বেরোলেই সেখানে নিয়ে যাব।” খবর রটে, কাছেই সল্টলেক স্টেডিয়ামে বহু মদন-অনুগামী জড়ো হয়েছেন। দাদা বেরোলেই মিছিল করে তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দেবেন তাঁরা।
ঘড়িতে ৪ টে ২২। আর কত ক্ষণ, ভেবে সকলেই যখন অস্থির হয়ে উঠেছেন, তখন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে খবরটা। মন্ত্রীর গ্রেফতারের খবর জানিয়ে দিল্লি থেকে সাংবাদিকদের কাছে এসএমএস পাঠান সিবিআইয়ের এক কর্তা। মদনের পাশাপাশি গ্রেফতার করা হয় সারদা-প্রধান সুদীপ্ত সেনের আইনজীবী নরেশ বালোড়িয়াকেও।
গ্রেফতারের খবর পেয়ে দুই ছেলে বাবার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তাঁরা অবশ্য কোনও কথা বলেননি। ছেলেরা চলে গেলেও অনুগামীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। সিবিআই চক্রান্তের অভিযোগ তুলে তাঁরা মদনের নামে ‘জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিতে শুরু করেন। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশের সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আনা হয় কিছু মহিলা পুলিশও।
এরই মধ্যে পরিবহণ মন্ত্রীকে গিয়ে দেখে আসেন চিকিৎসকেরা। খবর রটে, তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। নবান্নে সেই কথা জানান মুখ্যমন্ত্রীও। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তা হয়নি। বরং রাত সাড়ে ৮টার পর পুলিশি ঘেরাটোপে মদনকে বার করা হয়। দৃশ্যতই তখন বিধ্বস্ত পরম প্রতাপশালী মন্ত্রী। গায়ে যেমন-তেমন করে জড়ানো শাল। ঘাড় নিচু। সাংবাদিকদের প্রশ্নের কোনও জবাব না-দিয়েই পুলিশের গাড়িতে উঠে যান মদন। যাওয়ার পথে কয়েক জন অনুগামী পুলিশের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন। পুলিশ জোর করে তাঁদের সরিয়ে দেয়। তুষার চট্টোপাধ্যায় নামে এক অনুগামী এ ঘটনায় আহত হন। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।
গাড়ি ছুটে চলে ইলেকট্রনিক্স কমপ্লেক্স থানার উদ্দেশে। রাতটা এখানেই কাটাতে হবে মদন মিত্রকে, মমতার অতি ভরসার দক্ষিণ হস্ত হিসেবেই যিনি পরিচিত।