অনলাইনে ছাত্রছাত্রী ভর্তির দাবিতে বিজেপির মিছিল। শুক্রবার বিকাশ ভবনের সামনে শৌভিক দে-র তোলা ছবি।
যা আশঙ্কা করা হচ্ছিল, হল ঠিক তা-ই!
রাজ্য সরকার স্নাতক স্তরে অনলাইনে ভর্তির বাধ্যবাধকতা তুলে দিতেই ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে কলেজে কলেজে ছাত্র সংগঠনগুলির মধ্যে গোলমাল শুরু হয়ে গিয়েছে। দাদাগিরির অভিযোগ উঠতে শুরু করেছে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)-এর বিরুদ্ধে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আশঙ্কা, ফর্ম বিলির সময়েই যে-ভাবে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে, তাতে ফর্ম জমা এবং ভর্তির সময়ে গোলমাল আরও বাড়বে। ছাত্রছাত্রী ও তাঁদের অভিবাবকদের অনেকেই হেনস্থার আশঙ্কা করছেন।
শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় অবশ্য এই সব ঘটনাকে আমল দিতে রাজি নন। তাঁর মতে, সংবাদমাধ্যমই বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। কেন্দ্রীয় স্তরে অনলাইন চালু করার মতো অবস্থা এ বছর ছিল না। তবে যে-সব কলেজ নিজেদের মতো করে অনলাইনে ছাত্র ভর্তি করাতে চায়, তারা তা করছে। মন্ত্রীর বক্তব্য, রাজ্য শুধু মেধার ভিত্তিতেই স্নাতকে ছাত্র ভর্তির পক্ষপাতী। তা নিশ্চিত করতে সোমবার বিধানসভায় বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে বৈঠকে বসছেন পার্থবাবু। তাঁর আশ্বাস, ভর্তি প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক রং দেখা হবে না।
রাজ্যের প্রায় সব কলেজই ফর্ম দিতে শুরু করেছে। কলকাতার বেশির ভাগ কলেজে অনলাইন থেকে ফর্ম ডাউনলোড করে, তা পূরণ করে জমা দিতে হচ্ছে কলেজে। যোগ্য বিবেচিত হলে কলেজেই টাকা দিয়ে ভর্তি হতে হবে। ফর্ম পূরণ থেকে ভর্তি প্রক্রিয়ায় সাহায্যের জন্য বিভিন্ন কলেজে ছাত্র সংগঠন চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসে পড়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই সাহায্যের বদলে টাকা নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনগুলির মধ্যে রেষারেষি বাড়ছে। তবে টাকা নেওয়ার অভিযোগ মানতে চায়নি টিএমসিপি বা অন্য কোনও সংগঠন।
ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে এ দিন গোলমাল বাধে বহরমপুর কলেজ, জলপাইগুড়ির আনন্দচন্দ্র কলেজ এবং বারাসত কলেজে (সান্ধ্য)। এত দিন কলেজে রেষারেষিটা ছিল মূলত ছাত্র পরিষদ এবং টিএমসিপি-র মধ্যে। এ বার যুক্ত হয়েছে বিজেপি। এ দিন যে-তিনটি কলেজে গোলমাল হয়েছে, তার দু’টিতে টিএমসিপি এবং বিজেপি ছিল যুযুধান প্রতিপক্ষ।
ব্যতিক্রমও ছিল। মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর কলেজে এসএফআই, সিপি এবং টিএমসিপি-র চাপে অনলাইনে ভর্তি প্রক্রিয়া চালু করতে বাধ্য হলেন কর্তৃপক্ষ। শুক্রবার কলেজ পরিচালন সমিতির সভায় এই সিদ্ধান্ত সর্বসম্মত ভাবে গৃহীত হয়। বুধবার কলেজের পক্ষ থেকে অফলাইনে ভর্তির সিদ্ধান্ত হয়। আপত্তি তোলে এসএফআই নিয়ন্ত্রিত ছাত্র সংসদ। তাদের সমর্থন করে সিপি, টিএমসিপি। পরিচালন সমিতির সভাপতি ভজন সরকার বলেন, “শাসক ও বিরোধী সব ছাত্র সংগঠন অনলাইন চাইছে বলেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়েছে।”
তবে জঙ্গিপুর যে নেহাতই ব্যতিক্রম, তা মানছেন অধিকাংশ কলেজের অধ্যক্ষ। কলকাতার বিভিন্ন কলেজেও ছাত্র সংসদের দাদাগিরির ছবি স্পষ্ট হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সিপি, এসএফআই, বিজেপি-র অস্তিত্ব কার্যত নেই। কুশীলব টিএমসিপি-রই। এ দিন উত্তর থেকে দক্ষিণ কলকাতার বিভিন্ন কলেজে ঘুরে দেখা যায়, প্রায় সর্বত্রই মূল ফটকে টেবিল-চেয়ার পেতে বসেছেন সংসদের সদস্যেরা। কোথাও কোথাও তাঁদের গলায় ‘মে আই হেল্প ইউ’ লেখা কার্ড। কোনও ছাত্র বা অভিভাবক কলেজে ভর্তির ব্যাপারে খোঁজ নিতে এলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছেন গলায় কার্ড ঝোলানো স্বেচ্ছাসেবকেরা। ভর্তি ব্যাপারে নিশ্চয়তা দিচ্ছেন তাঁদের অনেকেই। তার জন্য অনেক জায়গায় টাকা নেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।
সব থেকে বড় গোলমালটা বাধে বহরমপুর কলেজে। সকাল ৯টায় ফর্ম বিলি শুরু হয়েছিল। ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের ফর্ম তুলতে এবং তা পূরণে সাহায্য করার জন্য কলেজের ভিতরে হেল্প ডেস্ক পেতেছিল টিএমসিপি এবং সিপি। তা নিয়েই সংঘর্ষ বাধে। তিন জন জখম হন। কলেজের অধ্যক্ষ সমরেশ মণ্ডল বলেন, “ফর্ম বিলি নিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। কিন্তু আচমকা বচসা থেকে দু’পক্ষে হাতাহাতি বেধে যায়।” আজ, শনিবার থেকে সেখানে প্রচুর পুলিশ থাকবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন জেলার পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর।
জলপাইগুড়ির আনন্দচন্দ্র কলেজে কাজিয়াটা যুব বিজেপি এবং টিএমসিপি-র মধ্যে। অনলাইনে ভর্তির দাবি নিয়ে যুব বিজেপি কলেজের সামনে পৌঁছতেই টিএমসিপি তাদের আন্দোলন ভেস্তে দেওয়ার চেষ্টা করে বলে অভিযোগ। প্রতিবাদে পথ অবরোধ হয়। জেলা যুব বিজেপি-র সম্পাদক অলোক চক্রবর্তী জানান, টিএমসিপি মারধরের হুমকি দিয়ে তাঁদের ফিরে যেতে বাধ্য করেন। টিএমসিপি-র সৌরভ সরকার বলেন, কলেজে পরীক্ষা চলছিল। তাই বিক্ষোভকারীদের ১০০ মিটার সরে চলে যেতে বলা হয়েছিল।
অনলাইনের দাবিতে বারাসত কলেজের (সান্ধ্য) অধ্যক্ষের কাছে স্মারকলিপি দিতে যায় বিজেপি। টিএমসিপি তাদের বাধা দেয় বলে অভিযোগ। মারামারি শুরু হয়ে যায়, তাদের কিছু কর্মী জখম হন বলে জানায় বিজেপি। ছ’জনকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। টিএমসিপি-র জেলা সভাপতি আব্দুল কালাম বলেন, “বহিরাগতেরা কলেজে ঢুকছে দেখে ছাত্রছাত্রীরা বাধা দিয়েছেন। এতে টিএমসিপি-র হাত নেই।”
কলেজে কলেজে গোলমালের মধ্যেও শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য তাঁর সিদ্ধান্তে অনড়। তিনি ফের জানান, অনলাইনে ভর্তি সরকার বন্ধ করেনি। তা বিলম্বিত করা হয়েছে। ১০ জুন থেকে বিকাশ ভবনে শিক্ষা দফতরের ‘হেল্প ডেস্ক’ চালু হবে। ভর্তি নিয়ে কিছু জানার থাকলে বা সমস্যা হলে সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সরাসরি সেখানে যোগাযোগ করা যাবে।
মন্ত্রী যা-ই বলুন, অনলাইনেই ছাত্র ভর্তি করার জন্য সরকারকে চাপে রাখতে চাইছে কংগ্রেস। বিধানসভায় এই নিয়ে সরব হবে কংগ্রেসের পরিষদীয় দল। এই দাবিতে মুলতুবি প্রস্তাব আনার কথাও ভাবছে তারা।