জরিমানা (রিটেনশন চার্জ) দিয়ে অবৈধ নির্মাণকে আইনি করার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল কলকাতা হাইকোর্ট। সেই রায় সম্পর্কে রাজ্য সরকারের অন্দরে মনোভাবও ছিল ইতিবাচক। কিন্তু বুধবার পুর-অধিবেশনে কলকাতার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় এই রায়ের বিরুদ্ধে ডিভিশন বেঞ্চে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় অন্য মাত্রা পেল পুরো পরিস্থিতি। আইন সংশোধন নিয়ে এ দিন রাজ্যের কাছে প্রস্তাব পাঠানোরও সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি তৃণমূলের সরকার এবং তাদেরই পুরসভা ভিন্ন পথে হাঁটছে?
পাশাপাশি প্রশ্ন উঠেছে, কোন বাধ্যবাধকতায় পুরসভা এমন সিদ্ধান্ত নিল? পুরসভারই একটা অংশের মতে, আসন্ন নির্বাচনের কথা ভেবেই এমন সিদ্ধান্ত। কিন্তু সে ক্ষেত্রে যাঁদের ভোটের কথা মাথায় রাখা হচ্ছে, তাঁরা নাগরিক-সংখ্যার নিরিখে ছোট অংশ। ফলে এই সিদ্ধান্ত কতটা সাধারণ মানুষের কথা ভেবে, প্রশ্ন উঠেছে তা নিয়েও। এই পরিস্থিতিতে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম শুধু বলেন, “প্রস্তাব আসার পরেই এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারব।”
এ দিন মেয়র কার্যত বুঝিয়ে দেন, বেআইনি নির্মাণ আইনি করার প্রক্রিয়া চালু রাখতে আগ্রহী পুরসভা। তাঁর যুক্তি, ৩০ বছর ধরে ওই প্রথা চলে আসছে। প্রয়োজনে বিল্ডিং রুল সংশোধনের জন্য রাজ্যের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হবে বলে তিনি জানান।
গত ২৫ জুলাই হাইকোর্টের ওই রায়কে স্বাগত জানিয়েছিল রাজ্য সরকার। নবান্নের একাধিক কর্তার ব্যাখ্যা ছিল, টাকা দিয়ে অবৈধ নির্মাণকে আইনি করার প্রথায় কিছু সংখ্যক মানুষ সুবিধা পান, যাঁদের অধিকাংশই প্রোমোটার। আর অসুবিধা হয় অনেকের। পুরভোটের আগে পুর-প্রশাসনকে স্বচ্ছ রাখতে হাইকোর্টের রায় মানা উচিত বলেই মত তাঁদের। অন্য দিকে, ওই রায়ে হতাশ কয়েক জন পুরকর্তা চান, রিটেনশন প্রথা চালু থাকুক। অন্যথায় পুরসভার আয় কমে যাবে। তাঁদের মতে, ওই প্রথা বন্ধ হলে পুর-ভোটের আগে তার প্রভাব পড়বে। তাই ডিভিশন বেঞ্চে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক বলে মনে করেন তাঁরা।
টাকা দিয়ে বেআইনি বাড়িকে বৈধ করার কারবার বেশ কয়েক বছর ধরেই চলছে। এ নিয়ে মামলাও হয়েছে। সম্প্রতি শহরের কিছু বাসিন্দার করা মামলার প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ওই প্রথা রদ করার রায় দেয়। তাতেই টনক নড়ে পুরকর্তাদের। যদিও পুর ও নগরোন্নয়ন দফতর হাইকোর্টের ওই রায়কে স্বাগত জানিয়েছিলেন। যার অর্থ, রাজ্যও চায় এই প্রক্রিয়া বন্ধ হোক।
এ দিন ডিভিশন বেঞ্চে যাওয়া নিয়ে মেয়রের বক্তব্যে বিব্রত নবান্নের কিছু কর্তা। তাঁদের কথায়, “এমন খবর জানা নেই।” নবান্ন সূত্রের খবর, জরিমানার নিয়ে অবৈধ নির্মাণকে আইনি করার পিছনে যে বিবিধ চক্র কাজ করে, সে ব্যাপারে সরকারও অবহিত। তাই এই প্রক্রিয়া বন্ধ হলে পুর-প্রশাসনে স্বচ্ছতা আসবে বলে মনে করে সরকারও। সেই সঙ্গে ওই রায়ের ফলে যাতে শহরের সাধারণ বাসিন্দারা বাড়ির রদবদলের ক্ষেত্রে বিপাকে না পড়েন, তাই পুরসভার হাতে বিশেষ ক্ষমতা দিতে আগ্রহী সরকার। যা আইন সংশোধন করে করা যেতে পারে বলে মনে করছেন নবান্নের একাধিক কর্তা।
যদিও ওই রায়কে স্বাগত জানিয়ে পুরসভার বিল্ডিং দফতরেরই এক আধিকারিক বলেন, “শহরবাসীর স্বাচ্ছন্দ্যের কথা ভেবেই ওই রায় কার্যকর করা প্রয়োজন।” তাঁর ব্যাখ্যা, রিটেনশন প্রথার সুযোগে পাঁচতলা ভিতের বাড়ি আটতলা হয়ে যাচ্ছে, যা বিপজ্জনক। যে কোনও সময়ে বাড়ি ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।
পুর-সূত্রের খবর, গত আর্থিক বছরে বিল্ডিং অনুমোদন থেকে পুরসভার আয় হয় ২২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬৫ কোটি শুধু রিটেনশন চার্জ বাবদ। অর্থাৎ মোট আয়ের ৩০ শতাংশ বেআইনি নির্মাণের জরিমানা থেকে। এক মেয়র পারিষদের কথায়, “রায় কার্যকর হলে ওই আয় থাকবে না। ফলে পুর-ভাঁড়ারেও টান পড়বে।” তা ভেবেই ডিভিশন বেঞ্চে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বলে পুরসভা সূত্রের খবর।