অভিজিতের মুখোমুখি অসন্তোষ লুকোননি পার্থ

প্রথমে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মুখোমুখি উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী। তার পরে মন্ত্রীর দরবারে গেলেন যাদবপুরের বৃহত্তম শিক্ষক সংগঠন জুটা এবং তৃণমূলের শিক্ষক সংগঠন ওয়েবকুপা-র প্রতিনিধিরা। শেষ বেলায় অ্যাম্বুল্যান্সে চড়ে পার্থবাবুর সঙ্গে দেখা করলেন যাদবপুরের অনশনকারী ছাত্রছাত্রীরা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:৪৯
Share:

জট কাটাতে শিক্ষামন্ত্রীর বৈঠকের দিনেই উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীর ইস্তফার দাবিতে মিছিল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারীদের। শুক্রবার। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য।

প্রথমে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মুখোমুখি উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী।তার পরে মন্ত্রীর দরবারে গেলেন যাদবপুরের বৃহত্তম শিক্ষক সংগঠন জুটা এবং তৃণমূলের শিক্ষক সংগঠন ওয়েবকুপা-র প্রতিনিধিরা।

Advertisement

শেষ বেলায় অ্যাম্বুল্যান্সে চড়ে পার্থবাবুর সঙ্গে দেখা করলেন যাদবপুরের অনশনকারী ছাত্রছাত্রীরা।

শুক্রবার বিকাশ ভবনে পরপর তিন শিবিরের সঙ্গে আলোচনা করেও যাদবপুর-জটে শিক্ষামন্ত্রীর মধ্যস্থতার চেষ্টা তেমন ফলপ্রসূ হল না। জটিলতা থেকেই গেল। মন্ত্রীর আবেদন সত্ত্বেও ছাত্রছাত্রীরা এ দিন গভীর রাত পর্যন্ত অনশন তোলেননি। বরং ব্লাড সুগার অনেকটা কমে যাওয়ায় অনশনকারী এক ছাত্রকে এলাকার একটি হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। দিনভর বৈঠকের নির্যাস কী, তা জানাতে সন্ধ্যায় উচ্চশিক্ষা সচিব বিবেক কুমারকে পাঠানো হয় আচার্য-রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠীর কাছে।

Advertisement

তিন দফা বৈঠকে বিশেষ আলোর দেখা না-মিললেও সরকারি সূত্রের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় অভিজিৎবাবুর ভূমিকায় মোটেই খুশি নন শিক্ষামন্ত্রী। অভিজিৎবাবুর সঙ্গে এ দিনের বৈঠকেও তিনি অসন্তোষ গোপন করেননি বলে বিকাশ ভবনের খবর। এমনকী পার্থবাবু এ দিনের বৈঠক নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যে-রিপোর্ট দিচ্ছেন, তাতেও অভিজিৎবাবুর বিরুদ্ধে কিছু কথা থাকতে পারে বলে জানাচ্ছে সরকারি সূত্রটি। তাই শেষ পর্যন্ত অভিজিৎবাবুকে পদ ছাড়তে হবে কি না, এ দিনের বৈঠকের পরে তা নিয়ে নতুন জল্পনা তৈরি হয়েছে।

এ দিনের বৈঠকের পরে উপাচার্যের কাছে জানতে চাওয়া হয়, পদ ছাড়ার জন্য তাঁর উপরে কোনও চাপ তৈরি হয়েছে কি না। হাত নেড়ে অভিজিৎবাবু জানিয়ে দেন, তাঁকে কোনও রকম চাপ দেওয়া হয়নি।

পার্থবাবু জল্পনার মধ্যে যেতে চাননি। তিনি বলেন, “আমি প্রথমেই ছাত্রছাত্রীদের বলেছি, তারা যেন এমন কোনও দাবি না-করে, যা শিক্ষামন্ত্রীর আওতাভুক্ত নয়। তবে আলোচনা করে পড়ুয়াদের খুব একটা অনড় মনে হল না। যদিও আমার কথা শুনে তারা সব মেনে নেবে, এমনটাও নয়।”

তা হলে কি উপাচার্যকে সরানোটা তাঁর আওতাভুক্ত নয়?

“আমি যা বলার স্পষ্ট বাংলায় বলেছি। আর কিছু বলব না,” সাফ জানিয়ে দেন শিক্ষামন্ত্রী।

ছাত্রছাত্রীদের ঘেরাও তুলতে পুলিশ ডাকা এবং পরে ক্যাম্পাসে পুলিশের তাণ্ডব, ২৮ অগস্ট হস্টেলে এক ছাত্রীর শ্লীলতাহানির অভিযোগের যথাযথ তদন্ত না-করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টার্নাল কমপ্লেন্টস কমিটি (আইসিসি) নিয়ম মেনে গঠন না-করা ইত্যাদি নিয়ে অভিযোগ তো আছেই। সেই সঙ্গে পঠনপাঠন, গবেষণার ক্ষেত্রেও অভিজিৎবাবু উপাচার্য হিসেবে যথাযথ ভূমিকা পালন করছেন না বলে সরব হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিবির। এই পরিস্থিতিতে সোমবার রাত থেকে অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন ১২ জন ছাত্রছাত্রী। মুশকিল আসানের জন্য পার্থবাবু এ দিন সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকেই আলোচনায় ডেকেছিলেন।

কী কথা হল পার্থবাবুর সঙ্গে?

“শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, উপাচার্যকে সরানোর এক্তিয়ার তাঁর নেই। আমাদের অনশন প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছেন মন্ত্রী। তবে দাবি আদায় না-হলে অনশন তোলা হবে না,” বললেন অনশনকারী এক পড়ুয়া। অনশনকারীরা মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে যাওয়ার পরে এক দল আন্দোলনকারী পড়ুয়া সল্টলেকের করুণাময়ী মোড় থেকে বিকাশ ভবনের পথে মিছিল শুরু করেন। যদিও বিকাশ ভবনের সামনে ১৪৪ ধারা জারি থাকায় তার আগেই ওই মিছিল আটকে দেওয়া হয়।

উপাচার্যকে সরানোর ব্যাপারে মন্ত্রী এ দিন তাঁদের কাছে নিজের এক্তিয়ারের সীমাবদ্ধতার কথা তুলেছেন বলে ছাত্রদের সাক্ষ্য। তবে এক্তিয়ারের বাইরে গিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের জটিলতা কাটাতে উদ্যোগী হয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। এ দিন তিনি বলেন, “উপাচার্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অভিভাবক। তবে ছাত্রছাত্রীদের হয়তো মনে হয়েছে যে, তারা সেই জায়গায় ঠিকঠাক কথা বলতে পারছে না। তাই আমার কাছে এসেছে নিজেদের কথা জানাতে।” যাদবপুরের অন্য একটি শিক্ষক সংগঠন আবুটা-র বক্তব্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্বশাসিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গোলমাল মেটাতে সরকারের কোনও ভূমিকাই থাকতে পারে না। তাই ওই সংগঠনের প্রতিনিধিরা এ দিনের বৈঠকে যাননি।

ভূমিকা আছে কি না, সেই বিষয়ে পার্থবাবু কিছু বলেননি। তাঁর কথায়, “উপাচার্য বেশ কিছু বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সেগুলি আমরা খতিয়ে দেখব। সমস্যা মিটে গেলে সরকারের তরফে তিনি কী ধরনের সাহায্য চাইবেন, তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছে উপাচার্যের কাছে।” জুটা যে-সব আর্থিক অনিয়মের (যেগুলি মূলত অভিজিৎবাবুর বিরুদ্ধেই) অভিযোগ জানিয়েছে, তা-ও খতিয়ে দেখা হবে। এই অভিযোগের তদন্তে বিশ্ববিদ্যালয় কত দূর এগিয়েছে, উপাচার্যের কাছে তা জানতে চেয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী।

পার্থবাবুর সঙ্গে কথা বলে বেরিয়ে অভিজিৎবাবু যান বিশ্ববিদ্যালয়ের সল্টলেক ক্যাম্পাসে। মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক প্রসঙ্গে সেখানে তিনি বলেন, “সরকারি কথা বলা যাবে না।” তবে সকালে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় সংবাদমাধমের প্রশ্নের জবাবে উপাচার্য বলেন, “ছাত্রছাত্রীরা আমার সন্তানের মতো। এরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পড়াশোনায় ফিরে আসুক। নিজেদের ভবিষ্যৎ তৈরি করুক।” অনশনকারীদের উদ্দেশে তাঁর পরামর্শ, “অনশন মোটেই অভিপ্রেত নয়। এতে খুব চাপ পড়ে। এর মধ্যে না-যাওয়াই ভাল। আন্দোলন চলতেই পারে। তবে আগেই বলেছি, যা হওয়ার আলোচনার মাধ্যমে হোক।”

উপাচার্য, শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী ও পড়ুয়া-প্রতিনিধিদের সঙ্গে দিনভর আলোচনায় প্রাপ্তি ঠিক কতটা?

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “সকলের সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করছিলাম, সমস্যাটা ঠিক কোথায়। কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব তৈরি হয়েছে।” সেই সঙ্গেই মন্ত্রীর দাবি, “আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, আমরা একটা সমাধানের পথে এগোচ্ছি। তবে আমি একটু সময় চেয়েছি। সকলেই নিজেদের কথা বলেছেন। সব দিক খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” প্রথম দিনেই তো বরফ গলে না। একটু সময় লাগবে, মন্তব্য মন্ত্রীর।

সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের অনড় মনোভাবই সমস্যাটাকে জিইয়ে রেখেছে বলে মনে করেন শিক্ষামন্ত্রী। একই সঙ্গে পার্থবাবু জানান, জট কাটানোর জন্য বারবার সকলের সঙ্গে আলোচনা করতে, এমনকী কারও কাছে গিয়ে কথা বলতেও তিনি পিছপা নন। সকলকেই নমনীয় হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী।

যদিও পার্থবাবুর আবেদনে কতটা সাড়া মিলবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই গিয়েছে। মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরে জুটা-র সাধারণ সম্পাদিকা নীলাঞ্জনা গুপ্ত বলেন, “আমরা অভিজিৎবাবুর অপসারণ চেয়েছি। সেই দাবিতে আমরা অনড়।” বিশ্ববিদ্যালয়ে সুষ্ঠু পরিবেশ ফেরাতে মন্ত্রীর কাছে ২১ দফা দাবি পেশ করেছে জুটা। ওয়েবকুপা অবশ্য উপাচার্যের অপসারণ চায়নি। তবে তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ে সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য সচেষ্ট হতে আবেদন জানিয়েছেন মন্ত্রীকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন