অভিজিৎকে তলব, প্রশ্নের মুখে পার্থই

অনুরোধ এবং আবেদন-নিবেদন করছিলেন অনেক দিন ধরেই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থা কাটাতে এ বার সরাসরি হস্তক্ষেপ করলেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। বিশ্ববিদ্যালয় তো একটি স্বশাসিত সংস্থা। তার দৈনন্দিন কাজে শিক্ষামন্ত্রী বা শিক্ষা দফতর হস্তক্ষেপ করবেন কেন, সেই প্রশ্ন উঠেছে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:১৯
Share:

দফতরের পথে উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তী।

অনুরোধ এবং আবেদন-নিবেদন করছিলেন অনেক দিন ধরেই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থা কাটাতে এ বার সরাসরি হস্তক্ষেপ করলেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। বিশ্ববিদ্যালয় তো একটি স্বশাসিত সংস্থা। তার দৈনন্দিন কাজে শিক্ষামন্ত্রী বা শিক্ষা দফতর হস্তক্ষেপ করবেন কেন, সেই প্রশ্ন উঠেছে।

Advertisement

শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশে উচ্চশিক্ষা দফতরের তরফে চিঠি পাঠিয়ে কাল, শুক্রবার যাদবপুরের উপাচার্য অভিজিৎ চক্রবর্তীকে বিকাশ ভবনে ডাকা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অচলাবস্থা কাটাতে সেখানকার বৃহত্তম শিক্ষক সংগঠন জুটা-র সঙ্গেও ওই দিন বৈঠকে বসার কথা শিক্ষামন্ত্রীর। নতুন উপাচার্য কাজে যোগ দেওয়ার পরে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিত্যদিনের কাজে বিকাশ ভবন হস্তক্ষেপ করছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। এ বার তার সঙ্গে যুক্ত হল যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ও। মন্ত্রীর উদ্যোগ এখন প্রশ্নের মুখে।

পার্থবাবু অবশ্য বলছেন, বাধ্য হয়েই তাঁকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “দিনের পর দিন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনটা চলতে দেওয়া যায় না। একটা না-একটা সময়ে সরকারকে হস্তক্ষেপ করতেই হতো।” পার্থবাবু তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়েছেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনের তুলনায় রাজ্যের ভাবমূর্তি অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই তাঁকে উদ্যোগী হতেই হচ্ছে। তবে শুক্রবার উপাচার্যের সঙ্গে তিনি বৈঠকে বসবেন, নাকি আলোচনা করবেন উচ্চশিক্ষা দফতরের সচিব, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রেখে দিয়েছেন তিনি। পার্থবাবু বলেন, “কে বৈঠকে বসবেন আর কী আলোচনা হবে, অত কথা এখন বলব না। তবে কোনও চাপের মুখেই অভিজিৎ চক্রবর্তীকে সরানো হবে না। কারণ, সেটা সম্ভব নয়।”

Advertisement

শিক্ষামন্ত্রীর এই ভূমিকা সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজে হস্তক্ষেপ হলেও যাদবপুরের যে-সব প্রবীণ শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের মানরক্ষায় আচার্য-রাজ্যপালের কাছে দরবার করেছেন, তাঁদের অধিকাংশই এর মধ্যে কোনও অনৈতিক কিছু দেখছেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরী বলেন, “যিনি ডাকলে সব থেকে উপযুক্ত হতো, তিনি রাজ্যপাল। কারণ, তাঁর এক্তিয়ার আছে। তবে পার্থবাবু শিক্ষামন্ত্রী। তিনি যদি উদ্বিগ্ন বোধ করে মিটমাটের চেষ্টা করেন, সেটাকে স্বাগত জানানো উচিত।” তবে আলোচনায় ডাকলেও পার্থবাবু কোনও নির্দেশ জারি করতে পারেন না বলে জানান সুকান্তবাবু।

প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায় অবশ্য এ ভাবে উপাচার্যকে বিকাশ ভবনে ডেকে পাঠানোটাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বশাসনের উপরে আঘাত বলেই মনে করছেন। তিনি বলেন, “শিক্ষামন্ত্রী উপাচার্যকে ডেকে পাঠানোয় এটাই প্রমাণিত হল যে, বর্তমানে শিক্ষা ক্ষেত্র সম্পূর্ণ ভাবে সরকারের হস্তগত। আচার্য, উপাচার্য, রেজিস্ট্রার, শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রীদেরই এই সমস্যা সমাধান করার কথা। শিক্ষামন্ত্রীর কোনও ভূমিকাই থাকতে পারে না।”

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অশোকনাথ বসু এবং জুটা অবশ্য এ ব্যাপারে সুকান্তবাবুর মতেরই সমর্থক। অশোকনাথবাবু বলেন, “যে-কোনও ধরনের আলোচনার মাধ্যমে যদি কোনও সমাধানসূত্র বেরোয়, তাতে ক্ষতি কী? এই পরিস্থিতিতে সেটাই কাম্য।” জুটা-র সভাপতি কেশব ভট্টাচার্যের মতে, এটা স্বশাসনে হস্তক্ষেপ নয়। শিক্ষামন্ত্রী যদি কোনও নির্দেশ জারি করে তা কার্যকর করতে বলতেন, তাতে হস্তক্ষেপের প্রশ্ন উঠত। “উনি আলোচনা চেয়েছেন। তা হতেই পারে,” বলছেন জুটা-প্রধান। জুটা অবশ্য নিজেরাই শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসতে চেয়ে বিকাশ ভবনে বার্তা পাঠিয়েছিল।

তাঁকে বিকাশ ভবনে তলবের ব্যাপারে উপাচার্যের বক্তব্য জানা যায়নি। কারণ, তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএসেরও জবাব দেননি। এ দিন জরুরি ভিত্তিতে ডাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসমিতির বৈঠকেও অচলাবস্থা কাটার কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি। অভিজিৎবাবু সমাবর্তন অনুষ্ঠানের মতোই কর্মসমিতির বৈঠকের মাঝপথে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যান।

জট কাটাতে পার্থবাবুর উদ্যোগে ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা কী হবে, বুধবার তা জানা যায়নি। আজ, বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে পার্থবাবুর দফতরে যোগাযোগ করে শিক্ষামন্ত্রী ও ছাত্র-প্রতিনিধিদের মুখোমুখি বসানোর চেষ্টা চালানো হবে। তাতে কেমন সাড়া মেলে, দেখে নিয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে বলে আন্দোলনকারীরা জানান। তবে উপাচার্যের পদত্যাগ নিয়ে শিক্ষামন্ত্রী আলোচনায় রাজি হলে তবেই তাঁরা বৈঠকে যাবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন ছাত্রছাত্রীরা। পদত্যাগের দাবি পূরণ না-হলে তাঁদের অনশনও চলবে।

কিন্তু কোনও পূর্বশর্ত রেখে তিনি যে কারও সঙ্গে আলোচনায় রাজি নন, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী। এ দিন শিলিগুড়িতে সাংবাদিক বৈঠকে তিনি বলেন, “বৈঠকের কোনও পূর্বশর্ত নেই। সব পক্ষকেই বুঝতে হবে, যাদবপুরের বিশ্বজোড়া খ্যাতি রয়েছে। তা যেন কোনও ভাবে ক্ষুণ্ণ না-হয়।” মন্ত্রীর বক্তব্য, তিনি বারবার জানিয়েছেন, শুক্রবার বিকাশ ভবনে থাকবেন। কেউ চাইলে সেখানে গিয়ে আলোচনায় বসতে পারেন।

এ দিনের কর্মসমিতির জরুরি বৈঠকে জট ছাড়ানোর কী হল?

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, কিছু কথা এবং বাদানুবাদ ছাড়া কাজের কাজ তেমন হয়নি। কর্তৃপক্ষের একাংশ বৈঠকে অভিযোগ তোলেন, ছাত্রছাত্রীরা খুব খারাপ ব্যবহার করছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। কিছু শিক্ষকের বিরপদ্ধে পাল্টা নালিশ ঠোকেন ইসি-র এক সদস্য (বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত নন)। তাঁর বক্তব্য, শিক্ষকদেরও অনেকে তো এখানে-সেখানে নানা ধরনের বিরূপ মন্তব্য করছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কী হবে? এই নিয়ে জোর বাদানুবাদ হয়। বিতর্কের ফয়সালা হয়নি, বিশ্ববিদ্যালয়ের জট কাটারও কোনও পথ মেলেনি।

কর্মসমিতির বৈঠক নিষ্ফলা কেন?

সরাসরি জবাব দেননি রেজিস্ট্রার প্রদীপ ঘোষ। বৈঠক পুরোপুরি ব্যর্থ, বলতে রাজি নন তিনি। প্রদীপবাবু জানান, ছাত্রছাত্রীদের দাবি মেনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টার্নাল কমপ্লেন্টস কমিটি (অভ্যন্তরীণ অভিযোগ সমিতি) পুনর্গঠন করা হবে শীঘ্রই। তবে উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি নিয়ে আলোচনার এক্তিয়ার তাঁদের নেই। রেজিস্ট্রার বলেন, “আমরা চাইব, ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় বসুক। বৃহস্পতিবার পার্থবাবুর দফতরে যোগাযোগ করে জানতে চাওয়া হবে, তিনি ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে আলোচনার জন্য সময় দিতে পারবেন কি না। তার পরে সেটা আন্দোলনকারীদের জানানো হবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তারাই নেবে।”


ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন