আমরা কোথায় যাব, বলছেন ক্ষতিগ্রস্তরা

দুশ্চিন্তার পারদ চড়ছে সারদা কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিগ্রস্তদের। শুক্রবার মুর্শিদাবাদে প্রচারে গিয়ে বিভিন্ন জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যা বলেছেন, কার্যত তাতেই বেশি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আতঙ্কে গ্রামগঞ্জের গরিব মানুষ। কী বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী? বহরমপুরের প্রচারসভায় মমতা বলেছেন, “সিবিআইকেই টাকা ফেরত দিতে হবে। আমারই তো ভাল হল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১১ মে ২০১৪ ০২:২৭
Share:

দুশ্চিন্তার পারদ চড়ছে সারদা কেলেঙ্কারিতে ক্ষতিগ্রস্তদের।

Advertisement

শুক্রবার মুর্শিদাবাদে প্রচারে গিয়ে বিভিন্ন জনসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যা বলেছেন, কার্যত তাতেই বেশি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আতঙ্কে গ্রামগঞ্জের গরিব মানুষ।

কী বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী? বহরমপুরের প্রচারসভায় মমতা বলেছেন, “সিবিআইকেই টাকা ফেরত দিতে হবে। আমারই তো ভাল হল। আমি বেঁচে গিয়েছি। গরিব মানুষের টাকা ফেরত দিচ্ছিলাম। ওদের সহ্য হল না।”

Advertisement

এখানেই প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। তাঁদের বক্তব্য, যদি গরিবদের টাকা ফেরত দেওয়াই রাজ্য সরকারের উদ্দেশ্য হয়, তা হলে মুখ্যমন্ত্রী কেন এখন নিজের দেওয়া প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসছেন? তা হলে কি ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা দেওয়াটা সরকারের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল? বিরোধীরা বলছেন সুপ্রিম কোর্ট রায়ে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে, সারদা কেলেঙ্কারির তদন্ত করবে সিবিআই, কিন্তু কমিশন নিজের মতো কাজ করবে। মানুষের অভিযোগ শুনে তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেবে। এমনকী, আইনের মধ্যে থেকে সারদা সংস্থার বাজেয়াপ্ত করা সম্পত্তিও বিক্রি করতে পারবে কমিশন। সিবিআইকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, রায়ে কোথাও এ কথা বলা নেই। আর রাজ্য যদি ওই নির্দেশ না মানে, তা হলে সরকারের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ উঠবে বলে প্রচ্ছন্ন হুঁশিয়ারি বিরোধী দলগুলোর।

সুপ্রিম কোর্টে সারদা মামলার আবেদনকারী কংগ্রেস নেতা আব্দুল মান্নান মনে করেন, মানুষকে বিভ্রান্ত করতেই টাকা ফেরতের প্রশ্নে মুখ্যমন্ত্রী এমন মন্তব্য করেছেন। তাঁর বক্তব্য, “সিঙ্গুরের জমি ফেরত নিয়ে উনি (মুখ্যমন্ত্রী) মানুষকে ধোঁকা দিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রেও তা-ই করেছেন।” বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের মন্তব্য, “মুখ্যমন্ত্রী যখন ‘বেঁচে গিয়েছি’ বলেন, তখন বুঝতে হবে ওঁর বাঁচার রাস্তা নেই। এ কথা বলে উনি বুঝিয়ে দিলেন, প্রতারিতদের পক্ষে নয়, আসলে প্রতারকদের পক্ষেই ছিল তাঁর সরকার।” সূর্যবাবুর মতে, মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যেই বোঝা যাচ্ছে, সারদা কেলেঙ্কারিতে তাঁর দল ও সরকারের ভূমিকা আড়াল করতে তিনি গরিব মানুষের টাকা ফেরানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিম বলেন, “সারদা-কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের জন্য সরকার পৃথক তহবিল করেছে। এখন সে তার দায়িত্ব এড়াতে পারে না। ইতিমধ্যে শ’খানেক আমানতকারী আত্মহত্যা করেছেন। তার দায়ও নিতে হবে সরকারকেই।”

সেলিমের দলেরই নেতা গৌতম দেবের দাবি, মুখ্যমন্ত্রীকে জেরা করতে হবে। কারণ তিনিও সারদার সুবিধাভোগী। সারদার সম্পত্তি কেন বাজেয়াপ্ত করা হল না, সেই প্রশ্ন তুলে গৌতমবাবু বলেন, “কেন মমতা সরকারি টাকায় সারদার চ্যানেল ও কাগজ বাঁচাতে গেলেন, উত্তর দিতে হবে।” কংগ্রেস নেতা সোমেন মিত্র অবশ্য মনে করেন, সিবিআই তদন্তের নির্দেশের পরে শ্যামল সেন কমিশন রাখার যৌক্তিকতা নেই। তাঁর বক্তব্য, মানুষকে বোকা বানানোর জন্যই ওই কমিশন গঠন করা হয়েছে।

তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা অবশ্য আলাদা। তিনি সাফ বলছেন সিবিআই যেমন তদন্ত করে অভিযুক্তদের ধরবে, তেমনই সারদার ক্ষতিগ্রস্ত আমানতকারীদের টাকা ফেরতের ব্যবস্থাও করবে। পার্থবাবুর কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে আশাবাদী বলেই ওই মন্তব্য করেছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের একটি সংস্থা যেখানে তদন্ত করেছে, তখন কেন্দ্র গরিব মানুষের টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করবে, এমন আশা করাটা কি অন্যায়?” তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় এ নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তাঁর বক্তব্য, “সব বোঝা যাবে ১৬ তারিখের (ভোটের ফল প্রকাশের দিন) পরে।” অর্থাৎ ভোটের ফলাফলেই যাবতীয় বিতর্কের উত্তর মিলবে, এটাই বোঝাতে চেয়েছেন মুকুলবাবু।

এ সব রাজনৈতিক কচকচিতে অবশ্য মাথাব্যথা নেই বনগাঁর বিচুলিহাটের বাসিন্দা বাবুসোনা পালচৌধুরীর। তাঁর বক্তব্য, “সিবিআই হচ্ছে, ভাল। কিন্তু আমাদের ক্ষতিপূরণ পাওয়া নিয়ে কথা। মুখ্যমন্ত্রী যদি বলেন, টাকা দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর কোনও দায় রইল না, তা হলে কোথায় যাব আমরা?” হিঙ্গলগঞ্জের বাসিন্দা সারদা-এজেন্ট কমল পাত্র বলেন, “বছরখানেক আগে মুখ্যমন্ত্রী যখন ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা সরকার করবে বলেছিলেন, তখন মনে জোর পেয়েছিলাম। এখন যা বলছেন, তাতে তো ফের শূন্যে ফিরে যাওয়ার অবস্থা।” সারদার আর এক এজেন্ট, বাদুড়িয়ার খলিলুর আহমেদের একটাই কথা, “সারদা-কাণ্ডের পরে অনেক এজেন্ট বা লগ্নিকারী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন। সিআইডি-সিবিআই জানি না। আমরা চিনি মুখ্যমন্ত্রীকে। তাঁর উদ্যোগে সরকার টাকা দেওয়া শুরু করলে বাড়ি বয়ে হুমকি আসা কমেছিল। এখন তো দেখছি, ফের বাড়ি ছাড়তে হবে।”

বাবুসোনা, কমল কিংবা খলিলুরের মতো মানুষগুলোর দুশ্চিন্তা আরও গভীর হয়েছে, যখন শুক্রবারই নবান্নে দাঁড়িয়ে রাজ্যের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র মুখ্যমন্ত্রীর সুরে সুর মিলিয়েছেন। অমিতবাবু বলেছেন “সুপ্রিম কোর্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেওয়ায় সারদা-কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে চলে গিয়েছে। কারণ, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার পরে তা নিলাম করে টাকা আদায়ের ক্ষমতা ওদেরই রয়েছে।” বিরোধীদের বক্তব্য, সর্বস্বান্তদের সুরাহা দিতে ৫০০ কোটি টাকার পৃথক তহবিল তৈরির কথা ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই খাতে এ পর্যন্ত ১৬৬ কোটি টাকা কমিশনকে দিয়েছে সরকার। এর পরে মুখ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী দু’জনেই যদি ক্ষতিপূরণের বিষয়টি কেন্দ্রের ঘাড়ে চাপিয়ে দেন, তা হলে গরিব মানুষগুলোর আতঙ্ক তো বাড়বেই।

সিপিএমের রাজ্য স্তরের এক নেতা বলেন, “পৃথক তহবিল ঘোষণার সময়েই আমরা প্রশ্ন তুলেছিলাম, আমজনতার করের টাকায় কেন প্রতারকদের সুরাহা দেওয়া হবে? তখন উনি (মুখ্যমন্ত্রী) আমাদের কথা শোনেননি। উল্টে আমাদেরই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন। তা হলে এখন কেন ‘আমার ভাল হল, আমি বেঁচে গিয়েছি’ বলছেন?

শনিবার ‘চিটফান্ড সাফারার ইউনিটি ফোরাম’-এর তরফে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে সিবিআই তদন্ত চলুক, এটাই তাদের দাবি। আগামী ১৪ তারিখ কলেজ স্কোয়ার থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত ফোরামের সদস্যরা ‘বিজয় মিছিল’ করবেন।” তবে এখনও তাঁদের আশঙ্কা, সিবিআইকে রাজ্য কোনও সাহায্য করবে না। কারণ, রাজ্য সরকার গোড়া থেকে ওই তদন্তের বিরোধিতা করে এসেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন