জয়ের পর এবিভিপি সমর্থকদের উচ্ছ্বাস। ছবি:সুমন বল্লভ।
খাতায় কলমে প্রধান বিরোধী পক্ষ বামেরা। কিন্তু ক্রমশই রাজ্য রাজনীতির ময়দানে ফিকে হয়ে আসছে লাল এবং অভিষেক হচ্ছে গেরুয়ার। শিক্ষাঙ্গনও তার ব্যতিক্রম নয়। শনিবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে খাতা খুলেছে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ (এবিভিপি)। পক্ষান্তরে, মাত্র চার বছর আগেও সেখানে যাদের কার্যত একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল, সেই এসএফআই একটিও প্রার্থী দিতে পারেনি।
অর্থাৎ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ (টিএমসিপি)-এর প্রধান বিরোধী হিসাবে উঠে এল এবিভিপি-ই।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের খবর, সেখানকার বালিগঞ্জ ক্যাম্পাসে জুট অ্যান্ড ফাইবার টেকনোলজি বিভাগের ১৮টি আসনের মধ্যে ১৪টি আসনে প্রার্থী ছিল। তার মধ্যে ১২টিতে এবিভিপি এবং ২টিতে শাসক তৃণমূলের ছাত্র সংগঠন টিএমসিপি জয়ী হয়েছে। বাকি ৪টি আসনে কোনও ছাত্র সংগঠনই প্রার্থী দেয়নি। এ ছাড়া কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বালিগঞ্জ ক্যাম্পাসে বিজ্ঞান বিভাগেও এবিভিপি ৫টি আসনে লড়ে সব ক’টিতেই জয়ী হয়েছে বলে ওই ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্ব জানিয়েছেন। এর আগে বালিগঞ্জ-সহ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও ক্যাম্পাসেই ছাত্রভোটে এবিভিপি লড়াই করেনি। এ বছর প্রথম বার জুট অ্যান্ড ফাইবার টেকনোলজি এবং বিজ্ঞান বিভাগে প্রার্থী দিয়ে তাঁদের সকলকে জেতানো গৈরিক ছাত্র সংগঠনের তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য। এবিভিপি-র নেতারা জানিয়েছেন, বালিগঞ্জ ক্যাম্পাসে খাতা খোলার কারিগর তৃতীয় এবং চতুর্থ বর্ষের ছাত্র রজনীশ সিংহ, অসিত বিশ্বকর্মা এবং শুভরথ কুমার। এঁদের মধ্যে শুভরথ সম্প্রতি টিএমসিপি ছেড়ে তাঁদের সংগঠনে যোগ দিয়েছেন। এবিভিপি নেতৃত্বের অভিযোগ, মনোনয়ন তোলা এবং জমা দেওয়া অনলাইনে হলেও আগাগোড়াই মনোনয়ন প্রত্যাহার করানোর জন্য টিএমসিপি হুমকি দিয়েছে। ফলে তাঁরা প্রথমে ১৪টি আসনে প্রার্থী দিলেও এক জন পরে মনোনয়ন তুলে নেন। আর এক প্রার্থীর তথ্যে কিছু ভুল থাকায় তাঁর মনোনয়ন বাতিল হয়। ১২ জন প্রার্থী লড়েছেন এবং জিতেছেন। এবিভিপি-র রাজ্য সহ-সভাপতি অভিজিৎ বিশ্বাসের দাবি, “অন্য দু’টি আসনে লড়লে সে দু’টিও আমরা পেতাম।”
বালিগঞ্জ ক্যাম্পাসে গেরুয়া আবির নিয়ে বিজয় উৎসব করেন এবিভিপি সমর্থকেরা। জয়ী ১২ জন প্রার্থীকে নিয়ে মিছিল করে তাঁরা বালিগঞ্জ ফাঁড়ি পর্যন্ত যান।
রাজ্যের শিক্ষাঙ্গনে এবিভিপি-র শক্তিবৃদ্ধি টের পাওয়া যাচ্ছে বেশ কিছু দিন ধরেই। খাগড়াগড় কাণ্ডের প্রেক্ষিতে গত ৭ নভেম্বর অবৈধ মাদ্রাসা বন্ধ-সহ বিভিন্ন দাবিতে রাজ্যের ২০টি জেলায় এবিভিপি-র কর্মসূচি ছিল। তার মধ্যে উত্তর ২৪ পরগনার বারাসতে এবিভিপি-র মিছিলে হামলা করার অভিযোগ ওঠে টিএমসিপি-র বিরুদ্ধে। হামলার প্রতিবাদে এবিভিপি সে দিন সড়ক অবরোধ করে বেগ দেয় জনতা এবং পুলিশ-প্রশাসনকে। এমনকী, ছাত্র সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নে টিএমসিপি-র বাধার প্রতিবাদে উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহ, জলপাইগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ারে বন্ধও করে ফেলেছে এবিভিপি।
এ দিকে, এসএফআই, যারা বাম জমানায় অধিকাংশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গায়ের জোরে বিরোধীদের প্রার্থী দিতে দিত না বলে অভিযোগ উঠত, তারা এখন টিএমসিপি-র সঙ্গে লড়াইয়ের জায়গাতেই নেই। মনোনয়ন নিয়ে টিএমসিপি-র সঙ্গে তাদের টক্কর দেওয়ার কোনও খবর নেই। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক জন প্রার্থী দিতে না পারায় ময়দান থেকে এসএফআইয়ের বিদায়ের সম্ভাবনাই ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে।
এসএফআইয়ের অবশ্য দাবি, তারাই রাজ্যের সর্বত্র টিএমসিপি-র সন্ত্রাসকে মোকাবিলা করছে। এসএফআইয়ের রাজ্য সম্পাদক দেবজ্যোতি দাস বলেন, “কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ১৮০টি মনোনয়ন তুলেছিলাম। সংগঠন না থাকলে ১৮০ জন প্রার্থী আমরা পেলাম কোথা থেকে? কিন্তু টিএমসিপি সন্ত্রাস করে আমাদের মনোনয়ন জমা দিতে দেয়নি। তাই লড়তে পারিনি।” দেবজ্যোতিদের দাবি, টিএমসিপি এবং এবিভিপি বামপন্থীদের হঠিয়ে রাজ্যের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ভাগাভাগি করে নিতে চাইছে। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও বলেন, “গত তিন বছর ধরে মূলত বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের কর্মীরাই তৃণমূলের হাতে আক্রান্ত হচ্ছেন। কারণ, তাঁরাই টিএমসিপি-র বিরুদ্ধে লড়ছেন।” বস্তুত, বামেদের বক্তব্য, রাজ্যে শাসক পরিবর্তনের পরে তৃণমূলের সন্ত্রাসে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়লেও ইদানীং ভয় ভেঙে কর্মীরা বেরোতে শুরু করেছেন। গ্রামে-গঞ্জে সমাবেশে উৎসাহব্যঞ্জক ভিড় হচ্ছে। কলকাতা শহরেও সম্প্রতি সিপিএম এবং বামফ্রন্টের মিছিলে ভাল ভিড় দেখা গিয়েছে।
বামেদের পরিসরে এবিভিপি-র উত্থান হলেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বালিগঞ্জ ক্যাম্পাসে জয়ী হয়েছে টিএমসিপি-ই। জুট অ্যান্ড ফাইবার টেকনোলজি বিভাগের ফল নিয়ে টিএমসিপির রাজ্য সভাপতি অশোক রুদ্রের প্রতিক্রিয়া, “আমরা ১০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দু’টোয় জিতেছি। এবিভিপি এবং এসএফআই এক হয়ে ওখানে জিতেছে।” ফলের পর্যালোচনা করা হবে বলে অশোক জানিয়েছেন। এবিভিপি ওই ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের নিয়ে বিশ্ৃঙ্খলা করেছে বলেও টিএমসিপির অভিযোগ।
জুট বিভাগে এবিভিপি-র জয়কে তৃণমূল নেতৃত্বও গুরুত্ব দিচ্ছেন না। এ দিন তৃণমূল ভবনে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পাশে বসে দলের প্রাক্তন ছাত্রনেতা বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় বলেন, “গত বার এসএফআইয়ের হাতে ওটা ছিল। এ বার সেটা গিয়েছে এবিভিপি-র হাতে।” বৈশ্বানরের কথা লুফে নিয়ে পার্থবাবু বলেন, “তৃণমূল ফার্স্ট বয়ই থাকছে। লড়াই হচ্ছে দ্বিতীয় এবং তৃতীয়র মধ্যে। সেটা যে সিপিএম এবং বিজেপি-র মধ্যে, তা এই ফল থেকেই স্পষ্ট।” এসএফআইয়ের দেবজ্যোতির অবশ্য বক্তব্য, “গত বার টিএমসিপি ওই বিভাগে আমাদের প্রার্থীদের মনোনয়ন দিতেই দেয়নি। তা সত্ত্বেও ওই বিভাগ ছাড়াই বালিগঞ্জ ক্যাম্পাসে আমরাই জিতেছিলাম।”