এ শহরে ভোট বয়কটের ডাক দিলেন ওঁরা, পদ্মাপার বহু দূর

হুতোম প্যাঁচার নকশা আমার অত্যন্ত প্রিয় বই। প্যাঁচার চোখে আদি কলকাতার গলি-ঘুপচি, মায় সে-কালের যৌনকর্মীদের বাড়ি, হুতোমের ভাষায় ‘বাবুদের মনুমেন্ট’— এ সব দেখার শখ তাই বহুদিনের। ভারতের লোকসভা নির্বাচন উপলক্ষে এ বার সেই সুযোগ মিলল। উত্তর কলকাতার এই রেড লাইট এরিয়া এখনও বিরাট। ভোটারের সংখ্যা প্রায় পঁচিশ হাজার। লিখছেন শাহীন আখতার

Advertisement

শাহীন আখতার

শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৪ ০২:৪০
Share:

হুতোম প্যাঁচার নকশা আমার অত্যন্ত প্রিয় বই। প্যাঁচার চোখে আদি কলকাতার গলি-ঘুপচি, মায় সে-কালের যৌনকর্মীদের বাড়ি, হুতোমের ভাষায় ‘বাবুদের মনুমেন্ট’— এ সব দেখার শখ তাই বহুদিনের। ভারতের লোকসভা নির্বাচন উপলক্ষে এ বার সেই সুযোগ মিলল।

Advertisement

উত্তর কলকাতার এই রেড লাইট এরিয়া এখনও বিরাট। ভোটারের সংখ্যা প্রায় পঁচিশ হাজার।

শুক্রবার বেলা দেড়টায় মসজিদবাড়ি স্ট্রিট ধরে যখন হাঁটছিলাম, যে কোনও পুরনো শহরের মহল্লাই মনে হচ্ছিল। মসজিদে জুমার নামাজ পড়ছেন মুসল্লিরা। বাচ্চারা ছুটোছুটি করছে রাস্তায়। খানিকটা এগিয়ে সোনাগাছির গলিতে ঢুকতে দৃশ্যপট আচমকাই বদলে গেল। তবে আশানুরূপ নয়। বেশির ভাগ ঘরের দোর-আঁটা। ‘এ’ ক্লাসের যৌনকর্মীরা দিবানিদ্রা যাচ্ছেন। জাগ্রতরা মোবাইল টেপাটেপি বা কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শোনায় মগ্ন। ভরযুবতী গৌরবর্ণা রোয়াক ঝাঁট দিচ্ছেন। কলতলায় হাঁড়িকুড়ি মাজার ধুম। দুর্গাচরণ মিত্র স্ট্রিটের গলিমুখগুলোতে ভরদুপুরে খদ্দেরের অপেক্ষায় যে মেয়েরা, তাঁরা গলদঘর্ম। ঘামে-মেকআপে মাখামাখি। রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ ছোট ছোট হাতপাখা নেড়ে মুখে রুজ-পাউডার ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। যা একটু ফুর্তির আমেজ, সেটা একমাত্র বাঁদর নাচের খেলা ঘিরে।

Advertisement

ভোটের আর মাত্র দশ দিন। ব্রথেলের দেয়ালগাত্রে জোড়া ফুল-এর নকশা ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়ল না। হাতুড়ি-কাস্তে বা হাতের পাঞ্জার ছাপ ক্ষয়ে ক্ষয়ে গেছে। এর আগে আমি জানুয়ারিতে যখন কলকাতায় আসি, তখন ‘ব্রিগেড চলুন’-এর তোড়জোড় চলছিল। রাস্তায় রাস্তায় শুভ্রবসনা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পায়ের চটি থেকে মাথা ইস্তক বিশাল বিশাল কাটআউট। যেন আকাশ থেকে নামছেন বা হাওয়ায় দোল খাচ্ছেন। দৃশ্যটা অভূতপূর্ব, দৃষ্টিনন্দন। আমার আনাড়ি চোখে ছিল তা-ই। কিন্তু লোকসভা নির্বাচনে কলকাতা এমন সাজহীন, বিবর্ণ কেন? ভোট চাইতে বাড়ি আসেন তো প্রার্থীরা? ‘তা আসেন।’ জানালেন দুর্বারের সদস্য ও যৌনকর্মী শেফালি রায়। ‘ভোটের যে প্রার্থী, সে হাতজোড় করে প্রতিটা মানুষের কাছে যায়, আমাদের কাছেও আসে। তখন কিন্তু আমরা ঘৃণার পাত্র থাকি না।’

এ আর নতুন কী? দুনিয়ার প্রায় সর্বত্রই এমন।

অভিনব হল, সোনাগাছির যৌনকর্মীরা এ বার নাকি ভোট দেবেন না। দুর্বার নেত্রী থেকে সোনাগাছির অনাবাসিক যৌনকর্মী— সবারই এক রা। পেশার স্বীকৃতি, ইমমরাল ট্রাফিকিং প্রিভেনশন অ্যাক্ট ১৯৫৬ (আইটিপি)-এর সংশোধনী প্রস্তাব বাতিল-সহ তিনটি দাবি সামনে রেখে তাঁরা এখন এককাট্টা হচ্ছেন।

সোনাগাছির লাগোয়া দুর্বার অফিস ‘অবিনাশ’-এ এইচআইভির রুটিন চেকআপে এসেছেন ছিপছিপে শ্যামাঙ্গী এক তরুণী, নাম পিঙ্কি। সোনাগাছিতে থাকেন না। দিনে দিনে কাজ সেরে বারাসত চলে যান। কথায় বাঙাল টান। নিজে থেকে বললেন, খুলনার মংলা থেকে চৌদ্দো বছর আগে এসেছেন। পাচারের কেস নয়। হাবড়ায় পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়েছিল। মারপিট সহ্য করতে না পেরে স্বামীর ঘর ছাড়েন আঠারো বছর বয়সে। সে সময় হাবড়া-অশোকনগর ট্রেনে এক মেয়ের সঙ্গে পরিচয়। তার হাত ধরে সোনাগাছি। ভোটের কথা উঠতে বললেন, ‘আমার তো ভোটের কার্ডই নেই।’ থাকলেও পিঙ্কি ভোট দিতেন না। দুর্বার ভোট বয়কটের ডাক দিয়েছে। তাই তাঁর ভোট দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সোনাগাছির আর এক জন অনাবাসী যৌনকর্মী সোমাও একই কথা বললেন অবিনাশ-এ বসে।

‘সবাই আপনাকে এ কথাই বলবে,’ বললেন দুর্বার কর্মী নির্মলা ঘোষ। ‘আমরা পঁয়ষট্টি হাজার যৌনকর্মী আছি দুর্বারে। তা ছাড়া আমাদের বাবু, আমাদের সন্তান, এই নিয়ে দুই লক্ষ ত্রিশ হাজারের বেশি ভোটার। একটা ভোটের জন্য প্রার্থী হেরে যায়। আমাদের কাছে আসা ওনাদের দরকার, আমাদের নয়।’

কথা ঠিকই। ১৯৯৫ সালে জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানী স্মরজিৎ জানা প্রতিষ্ঠিত ‘দুর্বার’ একটি শক্তির নাম। এইচআইভি সংক্রমণের হার পাঁচ শতাংশে কমিয়ে এনে রাষ্ট্রপুঞ্জের এডস কর্মসূচিতে সেরা অনুশীলন মডেল বলে আখ্যাত হয়েছে। এ হেন দুর্বারের ভোট-বয়কট হেলাফেলার বিষয় নয়। ‘আইটিপি-এর সংশোধনীর কথাই ধরুন না,’ বললেন নির্মলা। ‘সরকার বলছে, খদ্দের ধরে নিয়ে যাবে। খদ্দের না থাকলে আমরা খাব কী? সোজাসুজি আমাদের নাকটা ধরছে না, ঘুরিয়ে ধরছে।’ এ খসড়ার আর একটি ধারা নিয়েও বেজায় আপত্তি তাঁদের, যেখানে বলা হয়েছে যৌনকর্মীর সন্তানের বয়স ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে হলে মায়ের রোজগারে খেতে পারবে না। ‘এক জন মা হিসেবে আমি আমার স্বপ্নের জায়গা থেকে বলছি,’ শেফালি বললেন, ‘আমার সন্তান ইঞ্জিনিয়ার হবে, ডাক্তার হবে, উকিল হবে। সরকার কেন তা বন্ধ করতে চাইছে?’ তা ছাড়া সবাই একবাক্যে বললেন, শ্রমিকের যা যা অধিকার, তাঁদের তা পাওয়ার অধিকার রয়েছে।

পেশার স্বীকৃতি, মর্যাদার দাবি আমাদের বাংলাদেশের যৌনকর্মীদেরও। অনেক দিন থেকে নিষিদ্ধপল্লি উচ্ছেদে তাঁরা জেরবার হচ্ছেন। দেশের সব থেকে বড় নিষিদ্ধপল্লি টানবাজার-নিমতলি উচ্ছেদ হয় ১৯৯৯ সালের ২৩ জুলাই। এ যেন প্রাচীন সাম্রাজ্য ধসে পড়া। টানবাজার পল্লিতে ঢোকার মুখে হংস সিনেমা হল— সে-ও শতাব্দী প্রাচীন। জিমখানা, বাগান, দেওভোগ, বন্দর— আশপাশের জায়গার নামগুলো যেন সেই প্রাচীনত্বেরই স্মারক। এক সময়ের বন্দরনগরী নারায়ণগঞ্জে যৌনকর্মী-পল্লি গড়ে ওঠার কারণ ভিনদেশি নাবিকদের আনাগোনা। তার পর তো রমরমা পাটের ব্যবসা, পাকিস্তান আমলে আদমজি জুট মিলের মতো আরও আরও মিল-কারখানা গড়ে ওঠে এই চৌহদ্দিতেই। যে রাতে টানবাজার উচ্ছেদ হয়, পল্লির মেয়েরা বলেন, ফজরের আজানের দশ-পনেরো মিনিট আগে টানবাজার ভরে গিয়েছিল গাড়িতে। সে সব গাড়ির কোনও শব্দ ছিল না। উচ্ছেদের হোতা ছিলেন জনগণের ভোটে নির্বাচিত জাতীয় সাংসদ। পুনর্বাসনের জিগির তুলে প্রায় ছয় হাজার মেয়েকে রাতারাতি পথে বসিয়ে দেওয়া হল। উচ্ছেদের দেড় বছর পরই নির্বাচন। এ থেকেই বোঝা যায়, যৌনকর্মীদের ভোটের বিষয়টা বাংলাদেশে কত গৌণ।

উচ্ছেদের ছয়-সাত বছর পর টানবাজার ঢোকার মুখে দেখেছি মসজিদের নামাঙ্কিত পাথরের পেল্লায় তোরণ। মুখোমুখি বাইশটি দালানের মাঝখানে আগের সেই চিপাগলি। নীচের তলায় দোকানপাট আর দু’তিনটে সুতোর গুদাম। বাস্তুহারা যৌনকর্মীরা খদ্দের বসান নদীর পাড়ে, গাছতলায়, অন্ধকার গলি-ঘুপচিতে। রাত নামলে রেললাইনের ধারে ধারে বোরখা পরে দাঁড়িয়ে যান। বোরখা পরিহিতার কপালের ঝলমলে টিপই সমঝদারের তরফে শনাক্ত করার উপায়। নারায়ণগঞ্জবাসী উত্যক্ত। পরিবেশ খারাপ হচ্ছে। ঘরের বউ-ঝিরা নাকি যৌনকর্মী হয়ে যেতে চাইছে। সেই পুরনো কেচ্ছা।

যখন থেকে গণিকালয়ের জন্ম, তখন থেকেই যেন উচ্ছেদের পাঁয়তারা। হাল-আমলের ভারত-বাংলাদেশের ব্রথেল উচ্ছেদ নিয়ে কথা হয় দুর্বারের প্রতিষ্ঠাতা স্মরজিৎ জানার সঙ্গে। ‘কেয়ার বাংলাদেশ’-এর কনসাল্টেন্সি করার সুবাদে তিনি বাংলাদেশের ব্যাপারেও ওয়াকিবহাল। বলছিলেন, এখানেও যে উচ্ছেদের চেষ্টা হয় না, তা নয়। তবে দুর্বার হওয়ার পর রাজ্যের সর্বত্রই তা ঠেকানো গেছে। এখানে উচ্ছেদের উদ্যোক্তা প্রোমোটাররা। ১৯৯৭ সালে ঢাকার কান্দুপট্টিও উঠে যায় অর্থনৈতিক চাপে। সেটি ছিল পুরনো ঢাকার পাইকারি ব্যবসা কেন্দ্রে, নবাবপুর রোডের পাশে ইংলিশ রোডের গা ঘেঁষে। সেক্স ট্রেডের ব্যবসার থেকেও অনেক লাভজনক জায়গা ছিল সেটা। অন্য দিকে বাগেরহাট ব্রথেল উচ্ছেদ হয় ধর্মীয় মৌলবাদীদের ইন্ধনে। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর যেমনটি হয়েছিল উত্তরপ্রদেশে— বলছিলেন স্মরজিৎবাবু। মুরলীমনোহর জোশী তখন কেন্দ্রের এইচআরডি মিনিস্টার। তিনি বললেন, ‘আমার রাজ্যে ব্রথেল থাকবে মানতে পারছি না।’ ব্যস। সঙ্গে সঙ্গে দল বেঁধে ব্রথেল পোড়ানো হল লখনউ-ইলাহাবাদ-মেরঠে। ও-সব জায়গায় এখন ব্রথেল নেই, কিন্তু সেক্স-ওয়র্কার রয়েছে। যেমনটি ঢাকা-নারায়ণগঞ্জেও আছে। তাতে মেয়েদের অসহায়তা আর দুর্ভোগই বেড়েছে শুধু।

হালফিল যৌনকর্মীদের লড়াইটা অস্তিত্ব টেঁকানো-সহ নানাবিধ নাগরিক অধিকার আদায়ের। আজকের মতো জোট বেঁধে সভাসমিতি না করলেও ভিন্ন আঙ্গিকে সরব ছিল বিগত জমানার অবিভক্ত বাংলার নিষিদ্ধপল্লি। পল্লির মেয়েদের কাগজে ছাপা চিঠিতে, রোজনামচা বা আত্মজীবনীতে— কেন বা কী ভাবে পাড়ায় নাম লেখাতে হল, এ সব বয়ান রয়েছে। গৃহী জীবনের ক্লেশ-বঞ্চনার দলিল সে সব লেখাপত্র। তা শুধু মহাফেজখানা সমৃদ্ধই করেনি, তাঁদের লেখা জীবনকথা, প্রহসন, গীত, ছড়া-কবিতা কালোত্তীর্ণও হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জে প্রতি শুক্রবার জুমার নমাজ শেষে মুসল্লিরা ভাসমান যৌনকর্মীদের ছোট ছোট ঠেকগুলো চুরমার করে দেয়। গৃহস্থরা উঁচু বাড়ির ব্যালকনি থেকে ভাতের ফ্যান গায়ে ঢালে, প্রস্রাব-ভর্তি বোতল ফিক্কা মারে, লাঠি বাগিয়ে মারতে আসে। দেহোপজীবিনীর রোজগারের বখরা পেয়েও পুলিশ নাখোশ, সময় সময় ডান্ডা উঁচায়। মাথার ওপর ছাদ নেই, পায়ের তলায় মাটি নেই— এ অবস্থায় ভোট বা নির্বাচন নিয়ে কে ভাবে। তা বলে সোনাগাছির মতো ‘ভোট দেব না’ ডাক দেওয়ার হিম্মত নেই বাংলাদেশের ব্রথেলের মেয়েদের। সেক্সওয়র্কার্স নেটওয়র্ক অব বাংলাদেশ-এর প্রেসিডেন্ট জয়া বলেন, ‘এ রকম ডাক দেওয়া যায় দুর্বারের মতো সাংগঠনিক জোর থাকলে। তা ছাড়া দরকার স্মরজিৎ জানার মতো দরদি মানুষ, যিনি সোনাগাছির যৌনকর্মীদের বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন