তৃতীয় বারে সফল খুনিরা, দাবি পুলিশের

একটা-দু’টো নয়, আট গুলি অশোককে

নাইন এমএম পিস্তল থেকে ছ’টি। পাইপগান থেকে আরও দু’টি। পরপর আটটা গুলি এফোড় ওফোড় করে দিয়েছিল তৃণমূলের দাপুটে নেতা অশোক মুখোপাধ্যায়ের শরীর। ঠান্ডা মাথায় কাজ সেরে পাঁচ জনের ওই দলটি ঘটনার রাতে এলাকারই এক প্রভাবশালী নেতার আশ্রয়ে ছিল। পর দিন সকালে পুলিশ যখন হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ব্যস্ত, আততায়ীরা তখন নির্বিঘ্নে সিউড়ি স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে বিভিন্ন এলাকায় পাড়ি দিচ্ছে!

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত

খয়রাশোল শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৪ ০২:৪৯
Share:

ঘটনার পরে দোকানে পড়ে রয়েছে অশোক মুখোপাধ্যায়ের নিথর দেহ।

নাইন এমএম পিস্তল থেকে ছ’টি। পাইপগান থেকে আরও দু’টি। পরপর আটটা গুলি এফোড় ওফোড় করে দিয়েছিল তৃণমূলের দাপুটে নেতা অশোক মুখোপাধ্যায়ের শরীর। ঠান্ডা মাথায় কাজ সেরে পাঁচ জনের ওই দলটি ঘটনার রাতে এলাকারই এক প্রভাবশালী নেতার আশ্রয়ে ছিল। পর দিন সকালে পুলিশ যখন হত্যাকাণ্ডের তদন্তে ব্যস্ত, আততায়ীরা তখন নির্বিঘ্নে সিউড়ি স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে বিভিন্ন এলাকায় পাড়ি দিচ্ছে!

Advertisement

খয়রাশোলের প্রাক্তন ব্লক তৃণমূল সভাপতি অশোক মুখোপাধ্যায় খুনে ধৃত চার সুপারি কিলারকে জেরা করে ঘটনার পর থেকে সকাল অবধি এই বিবরণ তারা জানতে পেরেছে বলে পুলিশের দাবি। আর পুলিশের এই দাবি যে খয়রাশোলের সাম্প্রতিক খুনোখুনিতে শাসক দলের গোষ্ঠী-দ্বন্দ্বের তত্ত্বকেই শিলমোহর দিল, অন্তত তেমনটাই মনে করছে জেলার রাজনৈতিক মহল। ওই হত্যাকাণ্ডের পরে নিহতের পরিবার দীপক ঘোষ-সহ শাসক দলের আর এক প্রাক্তন ব্লক সভাপতি নিহত অশোক ঘোষ গোষ্ঠীরই ৪৪ জনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করে। অথচ প্রথম থেকেই জেলা তৃণমূল সভাপতি ওই ঘটনায় দলের কেউ-ই জড়িত নয় বলে দাবি করে আসছেন। বরং তাঁর অভিযোগের তির কয়লা মাফিয়াদের দিকে। এ দিন যদিও পুলিশই অনুব্রতর ওই তত্ত্ব খারিজ করে দিয়েছে। এখন গোটা কাণ্ডের তির দীপকবাবুর দিকে। গত দু’মাস ধরে ফেরার ওই তৃণমূল নেতাকে গ্রেফতার করাই এ বার পুলিশের প্রধান লক্ষ্য।

দলীয় সভায় পাশাপাশি দুই অশোক।

Advertisement

পুলিশ সূত্রের খবর, গত বছর ১২ অগস্ট খুন হয়েছিলেন অশোক ঘোষ। আর অশোক মুখোপাধ্যায়কে (যিনি অশোক ঘোষের খুনেই মূল অভিযুক্ত) খুন করা হয় ১৬ অগস্ট। তাই প্রথম থেকে পাল্টা খুনের তত্ত্বে বিশ্বাস করেই তদন্তে এগিয়েছে বলে পুলিশ সূত্রের খবর। এরই সঙ্গে পুলিশ মনে রেখেছে, খয়রাশোলের কোটি কোটি টাকার অবৈধ কয়লা কারবারের সাম্রাজ্যের দখলদারি নিয়ে দুই গোষ্ঠীর দীর্ঘ দিনের লড়াইয়ের ইতিহাসকেও। যদিও ৪৪ জনের নামে এফআইআর হয়েছিল, পুলিশ কিন্তু তাদের তড়িঘড়ি গ্রেফতারির রাস্তায় যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্তা বলছেন, “মনে রাখবেন, ওই হত্যাকাণ্ডে তৃণমূলেরই নেতা-কর্মীদের নাম জড়িয়েছিল। আবার রাজনৈতিক ভাবে খয়রাশোল ব্লকের রাশ তাদের হাতেই ছিল। তাই আমাদের যথেষ্ট সাবধানে পা ফেলে এগোতে হয়েছে।” খুনের এক মাসের মাথায় গত ১০ সেপ্টেম্বর আব্দুর রহমান, আশিস ঘোষ এবং কিশোর মণ্ডল নামে অভিযুক্তদের তালিকায় থাকা তিন তৃণমূল নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ধৃতদের জেরা করে ১৫ সেপ্টেম্বর বিশ্বরূপ চট্টোপাধ্যায় এবং ২৭ সেপ্টেম্বর স্বপন সেন, হাবুল শেখ, লক্ষ্মীকান্ত পাল (লখাই), কেদার আলি এবং সেখ সইবুল নামে দলেরই আরও পাঁচ নেতা-কর্মী ধরা পড়ে। পুলিশের দাবি, ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করেই ওই সুপারি কিলারদের কথা প্রথম জানা যায়। এর পরেই ওই সুপারি কিলারদের সন্ধানে অভিযান শুরু করে পুলিশ।

এ পর্যন্ত ধৃত ১৩ জনকে জেরা করে পুলিশ জানতে পেরেছে, অশোক মুখোপাধ্যায় হত্যাকাণ্ডের ছক কষা হয়েছিল ঘটনার বহু আগেই। এবং পুলিশের দাবি, দীপক ঘোষ-সহ বিরোধী গোষ্ঠীর অনেক নেতা মিলেই তার নকশা তৈরি করে ওই ভাড়াটে খুনীদের বরাত দেয়। আশিস ঘোষ ও কিশোর মণ্ডল মারফত দিলীপ কুমার (অপারেশনের লিডার) এবং বাবলু শর্মার (শু্যটার) সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। যেহেতু গত বছর ১২ অগস্ট অশোক ঘোষ খুন হয়েছিলেন, সেই মোতাবেক বদলা নিতে ওই একই দিনে অশোক মুখোপাধ্যায়কেও পৃথিবী থেকে সারানোর পরিকল্পনা করা হয় বলে পুলিশের দাবি। কাজ হাসিলের জন্য পাঁচ জনের ওই সুপারি কিলারদের দলের প্রত্যেককে ৯০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে বলে চুক্তি হয়েছিল। এ ছাড়াও কাজের শেষে তাদের প্রতি মাসে দশ হাজার টাকা করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল। ধৃতেরা জেরায় পুলিশকে জানিয়েছে, কয়লা সাম্রাজ্য থেকে ওই টাকা ম্যানেজ করা হবে বলে ঠিক হয়েছিল।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঘটনার সাত দিন আগে থেকেই ওঁত পেতে ছিল হামলাকারীরা। কিন্তু পুলিশ তত্‌পর থাকায় ১২ অগস্ট খুন করা সম্ভব হয়নি। এর পরেও খুনের চেষ্টা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তৃতীয় বার আততায়ীরা সফল হয়। পুলিশ জানায়, গত ১৬ অগস্ট রাত ৮টা কুড়ি নাগাদ পরিকল্পিত হামলা চালায় দিলীপদের ওই ভাড়াটে দল। সেই সময় পুজোর জন্য বাড়ির কাছেই একটি দোকানে ফল কিনতে এসেছিলেন অশোক মুখোপাধ্যায়। পুলিশের দেওয়া দুই রক্ষীর এক জন ছিলেন বাড়িতে, অন্য জন অশোকবাবুর পিছনে মিটার কুড়ি দূরে। ওই সময়ই দু’টি মোটরবাইকে চেপে পাঁচ আততায়ী দোকানের সামনে চলে আসে। খুব কাছ থেকে অশোকবাবুর শরীর লক্ষ্য করে পরপর গুলি চালিয়ে বোমা ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যায়। ধৃতেরা পুলিশি জেরায় জানিয়েছে, হামলা চালানোর জন্য প্রথম বাইকে ছিল দিলীপ কুমার ও অঞ্জু শর্মা। অঞ্জুর হাতে ছিল বোমা। আর পিছনের বাইকে ছিল বাবলু, দ্বিজেন্দ্র ও বদরুদ্দিন শেখ। অশোকবাবুর উপর নাইন এমএম পিস্তল থেকে ছ’টি গুলি চালায় বাবলু। পাইগান থেকে দু’টি গুলি চালায় দ্বিজেন্দ্র। কাজ হাসিল করে সেই রাতটা খয়রাশোলে ওই নেতার আশ্রয়ে কাটিয়ে প্রথমে সিউড়ি এবং সেখান থেকে ট্রেনে দুর্গাপুর পৌঁছে প্রাপ্য টাকা জন্য অপেক্ষা করছিল আততায়ীরা। সেখানে দিন দুই কাটানোর পরে টাকা পেয়ে তারা বিভিন্ন এলাকায় গা ঢাকা দেয়। জেরায় ওই সব তথ্য জানতে পারলেও খুনের ব্যবহৃত অস্ত্র পুলিশ এখনও উদ্ধার করতে পারেনি।

দীপকবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা না গেলেও তাঁর পরিবার সমস্ত অভিযোগই অস্বীকার করেছেন। উল্টে তাঁরা পুলিশেরই বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছেন।

—ফাইল চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন