বিহারের নির্বাচনের পুরো ফলাফল ঘোষণার আগেই তিনি টুইট করেছিলেন, ‘সহিষ্ণুতার জয়, অসহিষ্ণুতার পরাজয়’। বলিউড তারকা আমির খানের মন্তব্য ঘিরে যখন ফের পুরো মাত্রায় সামনে চলে এল অসহিষ্ণুতা-বিতর্ক, তোলপাড় শুরু হল দেশ জুড়ে, তখন নীরব থাকলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! অন্তত মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত আমির-প্রশ্নে তৃণমূল নেত্রীর কোনও টুইট নেই, ফেসবুক পোস্ট নেই। প্রয়াত অভিনেতা রবি ঘোষের ৮৫ তম জন্মদিনে মুখ্যমন্ত্রীর শ্রদ্ধার্ঘ্যের কথা জানাতে না ভুললেও তৃণমূলের তরফে আনুষ্ঠানিক ভাবে আমির নিয়ে কোনও বিবৃতি জারি করা হয়নি।
কয়েক মাস আগে ললিত মোদী বা সুষমা স্বরাজকে নিয়ে বিতর্কের সময়ে কৌশলী নীরবতা বজায় রাখলেও সাম্প্রতিক কালে অসহিষ্ণুতার প্রশ্নে ধারাবাহিক ভাবে বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন মমতা। শাহরুখ খান (ঘটনাচক্রে, যিনি মমতার সরকারের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর) অসহিষ্ণুতার প্রতিবাদ করতে গিয়ে সঙ্ঘের আক্রমণের মুখে পড়েছেন যখন, প্রতিবাদ করতে এগিয়ে এসেছে তৃণমূল। মুম্বইয়ে কনসার্ট করতে বাধা পেয়েছেন পাকিস্তানি গজল গায়ক গুলাম আলি। তাঁকে কলকাতায় অনুষ্ঠান করতে আসার জন্য খোলা আহ্বান জানিয়েছেন মমতা। অথচ আমিরের মন্তব্য নিয়ে যখন পক্ষে ও বিপক্ষে মতামতের ঝড়, সেই সময়ে তৃণমূল নেত্রীর ‘নিরপেক্ষ অবস্থান’ নানা জল্পনারই জন্ম দিয়েছে! সংসদের শীতকালীন অধিবেশন শুরু হচ্ছে কাল, বৃহস্পতিবার। তার ঠিক আগে তৃণমূলের এ দিনের অবস্থান আদতে বিজেপি-রই সুবিধা করে দেওয়ার কৌশল কি না, প্রশ্ন তুলতে শুরু করে দিয়েছে অন্যান্য দল।
বস্তুত, তৃণমূলের অবস্থান ঘিরে জল্পনা আরও ঘোরালো হয়েছে তাদের সংসদীয় দলের তরফে ডেরেক ও’ব্রায়েনের বিবৃতিতে। ঘটনা যে, তাঁর বিবৃতিতে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থানই নিয়েছেন তৃণমূলের রাজ্যসভার দলনেতা। তিনি বলেছেন, ‘সরকার পথ হারিয়েছে কিন্তু ঔদ্ধত্য হারায়নি! তারা সংসদীয় রীতিনীতি নিয়ে একই রকম ভাবে তামাশা করে যাচ্ছে।’ কিন্তু একই সঙ্গে ডেরেক এ-ও উল্লেখ করেছেন, ‘বড় বড় কথা যা-ই বলুক, দু’টো বড় জাতীয় দল বিজেপি এবং কংগ্রেসই সর্বাগ্রে সংসদের ক্ষতি করতে চলেছে। কিন্তু তৃণমূল মনে করে, সংসদের আসন্ন অধিবেশন শুধু হইচই আর বয়কটে পণ্ড হওয়া উচিত নয়। এই অধিবেশনের একেবারে গোড়া থেকেই বিক্ষোভে ঝাঁপিয়ে পড়া দেশবাসীর স্বার্থের পক্ষে ভাল কাজ হবে না’। অধিবেশন শুরুর আগে আজ, বুধবার সংসদে সর্বদল বৈঠকে যোগ দিয়ে তৃণমূলের তরফে দুই কক্ষের দুই নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ডেরেক তাঁদের এই অবস্থানের কথাই তুলে ধরবেন।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এ বারের অধিবেশনে অ-বিজেপি দলগুলির জোট গড়ে নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে কোণঠাসা করার লক্ষ্যেই কিছু দিন ধরে ঘুঁটি সাজাচ্ছিল তৃণমূল। পটনায় নীতীশ কুমারের শপথ অনুষ্ঠানের অবসরে কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধীর সঙ্গে তৃণমূল নেত্রীর ‘সৌজন্য সাক্ষাতে’র পরে দু’দলের কক্ষ সমন্বয়ের প্রস্তুতি আরও জোরদার হয়েছিল। অথচ তার পরেও আমির-প্রশ্নে কংগ্রেসের চড়া সুরের বিপরীতে তৃণমূলের নীরবতা এবং সংসদীয় দলের তরফে কংগ্রেসকেও কাঠগড়ায় তোলা কি সেই অর্থে ছন্দপতন নয়? এই প্রশ্ন তুলে বামেদের মতো কিছু অ-বিজেপি দল এর মধ্যেই অন্য গন্ধ খুঁজে পেতে শুরু করেছে!
ডেরেকের অবশ্য ব্যাখ্যা, তিনি নতুন কিছু বলেননি। জাতীয় রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহ দেখে তাঁদের দলের অবস্থান ফের স্পষ্ট করে দিয়েছেন মাত্র। বিজেপি বা কংগ্রেস যা-ই করুক, তৃণমূল ‘গঠনমূলক বিরোধী’ দলের ভূমিকাই সংসদে পালন করবে বলে জানাচ্ছেন ডেরেক। আর বিজেপি-কে নিয়ে তাঁদের অবস্থান কিছু মাত্র লঘু হয়নি বোঝাতে তৃণমূলের জাতীয় মুখপাত্রের আরও মন্তব্য, ‘‘বিজেপি-র সাংস্কৃতিক জেহাদ এবং অসহিষ্ণুতার ফতোয়া নিয়ে সংসদে খোলাখুলি বিতর্কই আমরা চাই।’’ মমতার অধুনা প্রিয় দোসর নীতীশের দল আবার বলে রেখেছে, কেন্দ্রের ‘অসহিষ্ণু’ মন্ত্রীদের ইস্তফার দাবি না মানা হলে সংসদ চলতে দেওয়া উচিত হবে কি না, তারা ভেবে দেখবে! নানা ‘মিত্রে’র নানা মতেই কি ধন্দে পড়ছে তৃণমূল?