কাজটা যেন শেষ করতে পারে, দেখো মা

কী যে শখ লোকটার! কুড়ি কুড়ি বছরেও তা জানা হল না। এখন তা-ও ছেলেটা বড় হয়েছে। নইলে ওঁর সঙ্গে কোথাও গেলে সে জাপানই যা-ও বা আমেরিকা, হোটেলের ঘরেই বন্দি থাকতে হবে। উনি হয়তো তখন কনফারেন্সে ব্যস্ত, প্রেজেন্টেশন আছে। অগত্যা সে বার টোকিওয় মা-ছেলেতে মিলেই ট্যুরিস্ট বাসে বেরিয়ে পড়া হল। লিখছেন ঋজু বসু

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:২৯
Share:

কী যে শখ লোকটার! কুড়ি কুড়ি বছরেও তা জানা হল না।

Advertisement

এখন তা-ও ছেলেটা বড় হয়েছে। নইলে ওঁর সঙ্গে কোথাও গেলে সে জাপানই যা-ও বা আমেরিকা, হোটেলের ঘরেই বন্দি থাকতে হবে। উনি হয়তো তখন কনফারেন্সে ব্যস্ত, প্রেজেন্টেশন আছে। অগত্যা সে বার টোকিওয় মা-ছেলেতে মিলেই ট্যুরিস্ট বাসে বেরিয়ে পড়া হল।

উনি ফিরে এসে শুনে হাসেন, ‘এই ভাল...বুদ্ধির কাজ করেছ।’ নিজে ফাঁক পেলে যে ঘুরবেন না, তা নয়! কিন্তু মনটা সারাক্ষণ কাজেই ডুবে। এ বারও জেনিভায় একটা বক্তৃতার নিমন্ত্রণ ছিল। কাজ মিটতেই ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন। পুজোর আগেই কলকাতা ফিরে এলেন।

Advertisement

ঘুমন্ত স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে এখন মাঝেমধ্যে দুশ্চিন্তা হয় নীলিমার। অল্প সুগার ধরেছে মাস কয়েক আগে। প্রেশারের ওষুধের পাওয়ারটাও বাড়াতে বলেছেন ডাক্তার। এ সব বুঝি চূড়ায় ওঠার ট্যাক্স? যত ক্ষণ জেগে আছেন, তত ক্ষণ একটাই চিন্তা! ‘বন্ধন’ এখন মানুষটাকে পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে।

স্বাধীন দেশে বাঙালির প্রথম ব্যাঙ্ক হতে চলেছে ‘বন্ধন’। তার কর্ণধার চন্দ্রশেখর ঘোষ। এই পুজোর পরের পুজো! তার আগেই শুরু হবে অপারেশন। তাই নিয়োগ চলছে জোর কদমে। সেক্টর ফাইভের বহুতল অফিসের চেম্বারে বসে বন্ধনের সিএমডি মৃদু হাসেন, “দেওয়ালের লেখাটা কিন্তু আমি আগেই পড়ে ফেলেছিলাম। এত বড় অফিস সেই জন্যই।” তখন অনেকেই মুখ টিপে হেসেছিল। গলির সব থেকে উঁচু বাড়িটার দশ তলায় কনফারেন্স রুম, প্রেক্ষাগৃহের ব্যবস্থা হবু ব্যাঙ্কের জন্যই। দু’বছর আগেই তৈরি। ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার দফতরে এ সব ঝকমারি লাগে না!

ন’তলায় সিএমডি-র ঘরের পাশে আরও দু’টো ঘর তখনই সাজানো হয়। বাইরে লেখা, এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর। তা-ও ব্যাঙ্কের কথা ভেবে। এখনও খালি ঘর দু’টো। আর কিছু দিনেই ভরে যাবে। মাস ছয়েক আগে অম্বানী-বিড়লাদের মতো হেভিওয়েটকে কাত করে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের আস্থা ছিনিয়ে নেওয়াটা কোনও ‘ফ্লুক’ ছিল না। দেশের ২২টি রাজ্যে ৬০ লক্ষ মানুষের আস্থার ফসল।

টেনশনটা সে জন্যই! বছর চোদ্দো আগে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পাঁচ হাজারি চাকরি ছেড়ে শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন চল্লিশের যুবক। স্বপ্ন ছিল বড় কিছু করার। স্রেফ চাকরি-চাকরি, পয়সা-পয়সা নয়। “বিশ্বাস করুন, শুধু নিজের কথা ভাবিনি আমি। গরিব মানুষদের একটু এগিয়ে দিতেও চেয়েছিলাম!” বুঝতে ভুল হয়নি, গরিব মানুষ নিজের পায়ে না-দাঁড়ালে সেবার প্রকল্পে লাভ হয় না বেশি দূর। অতএব আরও বেশি মানুষের পাশে দাঁড়াতে খুদে এনজিও থেকে মাইক্রো ফিনান্স কোম্পানিতে উত্তরণ। এ বার যা ব্যাঙ্ক হতে চলেছে।

চন্দ্রশেখরের ভয়টা তখন স্রেফ নিজেদের নিয়ে ছিল! এখন গ্রাহক-সাম্রাজ্য ছাড়াও ১৩ হাজার কর্মীর ভার। তার সঙ্গে আর একটা ভাবনাও তাড়া করছে, “এটা কিন্তু দেশের দেওয়া দায়িত্ব। আমায় প্রমাণ করতে হবে বাঙালি পারে!”

এ দেশের ব্যাঙ্কের ইতিহাসে বাঙালির অধ্যায় এখন ধূসর অতীত। কয়েকটি নাম ঘুরে-ফিরে আসে! ব্রিটিশের সঙ্গে ব্যাঙ্কের পত্তন করা প্রিন্স দ্বারকানাথ, শিলাইদহে সমবায় ব্যাঙ্কের রূপকার রবীন্দ্রনাথ, ইউনাইটেড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাঙ্ক-খ্যাত যদুনাথ রায়, ইউনাইটেড ব্যাঙ্কের নেপথ্যে কুমিল্লার দত্তরা...স্টেট ব্যাঙ্কের শিকড়েও তো কলকাতা। চন্দ্রশেখর বলেন, পঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক বা দক্ষিণের বিজয়া ব্যাঙ্ক তাদের প্রতিষ্ঠাতাকে মনে রেখেছে। ইউনাইটেড ব্যাঙ্কে দত্তদের কারও একটা ছবি অবধি নেই। বাঙালি হিসেবে এই জায়গাটাও মনে লাগে বই কী!

সেক্টর ফাইভের এই গলিতে আরও একটা বিষয়ও বাঙালির ভোলা কঠিন। ‘বন্ধনে’র বাড়িটা যখন আস্তে আস্তে মাথা তুলছে, তখন ক’টা বাড়ি দূরেই রমরমিয়ে চলত আর এক অফিস। বন্ধনের ডিএন ৩২-এর কাছেই ডিএন-২৯। কুখ্যাত সারদা-গোষ্ঠীর ঘাঁটি। সমসময়ের এ এক বেয়াড়া ঠাট্টা যেন!

সারদার অফিসে যখন নিত্য পুলিশ-সিবিআইয়ের হানাদারি, তখন নতুন দিগন্তের পথে ‘বন্ধন’।

বন্ধনের গেটে লেখা ‘হোপ ফর দ্য পুওর’! সরকারি জনধন যোজনা বলছে, বিকাশ ঘটাতে গরিবগুর্বোদের বেশি করে ব্যাঙ্কের আওতায় আনো। পাড়াগাঁয়ে দরিদ্রদের পুরনো বন্ধু ‘বন্ধন’। চন্দ্রশেখর বলেন, “চিটফান্ডে আস্থা রেখে যাদের স্বপ্ন লুঠ হয়েছে, তাদের পথ দেখানোও ব্যাঙ্ক বন্ধনের স্বপ্ন।”

কাজের তাই শেষ নেই! ন’তলার অফিস ঘরের প্রকাণ্ড কাচে চোখ রেখে সল্টলেকের পুজোর আলো এখন ঘোলাটে লাগে। আশৈশব ত্রিপুরার আগরতলার কাছের গ্রামে পুজো কেটেছে চন্দ্রশেখরের। কিন্তু শিউলির গন্ধটা কী রকম, আজ মনে পড়ে না! ঢাকের বাদ্যি, ঠাকুর তৈরির উত্তেজনা, সব কিছুই ফিকে। স্ট্যাটিসটিক্সের এমএসসি হেসে বলেন, ‘‘রিগ্রেশন অ্যানালিসিস, হাইপোথেসিস প্রোব্যাবিলিটিও তো মুছে গিয়েছে।”

আর বিয়ের পরের প্রথম পুজো, পুজোর গান...এ সব? প্রশ্ন শুনে হেসে কুটিপাটি চন্দ্রশেখর-জায়া নীলিমা। বন্ধনের কাপ্তেন কিন্তু গম্ভীর। থেমে থেমে বলেন, “সামনের দিকে তাকিয়েই ডিভাইস ফুল হয়ে আছে। আর র্যামে ধরবে না!”

ছেলেবেলার পুজোর একটা কথা শুধু ভুলতে পারেননি। আগরতলার কাছে বাবার মিষ্টির দোকান। উদ্বাস্তু পরিবারের বেঁচে থাকার ভরসা। মিষ্টির দোকানে অমানুষিক খাটনি পুজোয়। ছোট দোকানে অত কর্মচারী কই! হাফপ্যান্ট পরা শ্যামলাবরণ ঢ্যাঙা একটা ছেলে তাই ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরোটা বেলত, জিলিপি আঁকত কি রসগোল্লা ফোটাত। অফিসের এসিটা ফুলস্পিডে চললেও ময়রার ভিয়েনের চুল্লির তাপটা এখনও টের পান চন্দ্রশেখর।

তখন টানা খাটতে খাটতেই ঝিমুনি আসত। হয়তো ঘুম কাটাতেই একটু বেরিয়ে প্যান্ডেলে যাওয়া। ন’তলায় বসে উঠে আসার এই পথটা স্পষ্ট দেখেন চন্দ্রশেখরবাবু।

থেকে থেকে শুধু একটাই আফশোস! শুরু করতে বড্ড দেরি হয়ে গেল। তুলতুলে গদির বদলে নিমকাঠের চেয়ারে বসে অফিস করেন চন্দ্রশেখর। পিঠ-টিঠে কোনও ব্যথায় নয়! মনে রাখতে, জীবনের পরিণতিটা কোথায়। “এটা ভাবলে হাঁটার স্পিড বাড়ে! দশ বছরে দেশের তিনটে ব্যাঙ্কের একটা হওয়াই আমাদের লক্ষ্য!”

মাঝ-পঞ্চাশের গেরস্ত পুজোয় তাই নিখাদ ছুটির গন্ধ নেই। সার্ভে পার্কের সংসারের কর্ত্রী তা মেনে নিয়েছেন। “সপ্তমী হয়ে অফিস হয়তো বন্ধ হবে, কিন্তু ও তো বাড়িতেও অফিসই করবে!”

কুড়ি কুড়ি বছরে জীবন অনেক পাল্টেছে। সুতি থেকে সিল্কের শাড়ি। বাস-ট্রাম থেকে অফিসের গাড়ি। দেহরক্ষী, টেনশন...প্রৌঢ়ত্বেও নতুন লড়াইয়ের ময়দান। পুত্র অংশুমান, ক্লাস ইলেভেন। তার মনে হয়, চুলে পাক ধরা বাবা যেন টেস্ট ম্যাচের ওয়ার্ম আপে ব্যস্ত।

নীলিমার গলাটা ধরে আসে, সারা জীবন স্ট্রাগল করে গেল! মণ্ডপে গিয়ে আর কী চাইব! শুধু ওকে কাজটা শেষ করার সময় দিও মা...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন